Saltlake

রবিনসন কাণ্ডের ছায়া? সল্টলেকের বাড়িতে ১৪ দিন মায়ের মৃতদেহ আগলে ছেলে

দেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তে পাঠানোর পাশাপাশি প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ খবর করা শুরু করেন তদন্তকারীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:৪৯
Share:

মায়ের দেহ আগলে থাকা মৈত্র ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র

রবিবার রাতে ফোনটা পেয়ে রীতিমত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বিধাননগর উত্তর থানার আধিকারিকরা। ফোন করে এক যুবক বলেন, “আমি মৈত্র ভট্টাচার্য বলছি। বিই-২২০ থেকে। আমার মা মারা গিয়েছেন বেশ কয়েকদিন আগে। বডিটা নিয়ে যান।”

Advertisement

দ্রুতই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ। নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে বেল বাজাতে দরজা খুলে দেন বছর তিরিশের এক যুবক। তিনিই এক তলার একটি ঘরে নিয়ে যান পুলিশকে।

গিয়ে দেখা যায়— ভিতরের ঘরে বিছানার উপর পড়ে রয়েছে এক বৃদ্ধার দেহ। কঙ্কালসার চেহারাই শুধু হয়নি, গোটা দেহই পচে গলে গিয়েছে। পুলিশি পরিভাষায় হাইলি ডিকম্পোজড্। তার পাশে গিয়েই বসে পড়েন ওই যুবক। তিনি পুলিশকে বলেন, বেশ কয়েকদিন আগে মা মারা গিয়েছেন। তার পর মায়ের দেহ নিয়ে ওই ঘরেই ছিলেন তিনি।

Advertisement

আরও পড়ুন: ঘরে টেবিলে ঘুমোচ্ছেন সুন্দরাইয়া, বারান্দায় শুয়ে থাকতেন স্বেচ্ছাসেবক নিরুপম

দেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তে পাঠানোর পাশাপাশি প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ খবর করা শুরু করেন তদন্তকারীরা। তাঁরা জানতে পারেন, বাড়িটি গোরাচাঁদ ভট্টাচার্যের। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গোরাচাঁদ ছিলেন নামী চিকিৎসক। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। কৃষ্ণার বয়স হয়েছিল ৬৫-র মতো। ২০১৩ সালে মারা যান গোঁরাচাদ। মৈত্রের কথা অনুযায়ী, তিনি গোরাচাঁদ-কৃষ্ণার একমাত্র ছেলে।

এই বাড়িতেই থাকতেন মা ও ছেলে। —নিজস্ব চিত্র

পুলিশ রাতেই মৈত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে জেরা করতে গিয়ে উঠে এসেছে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী তথ্য। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কখনও মৈত্র বলেছেন— কৃষ্ণার মৃত্যু হয়েছে আট-ন’দিন আগে। আবার কখনও বলছেন— ১৮-১৯ দিন আগে। কিন্তু কেন তিনি মা মারা যাওয়ার পর কাউকে খবর না দিয়ে মায়ের দেহ সঙ্গে নিয়ে ছিলেন, তার কোনও উত্তর দেননি মৈত্র।

আরও পডু়ন: পর্ন সাইট রুখতে গিয়ে খাল কেটে কুমির ডেকে আনল কেন্দ্র?

প্রতিবেশীরা বলেন, ছোট বেলা থেকেই সামান্য ‘পাগলাটে’ আচরণ করতেন মৈত্র। তবে প্রথমে তা কখনও মাত্রা ছাড়া ছিল না। তাঁর মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে গোরাচাঁদের মৃত্যুর পর থেকে। শেষ দু’বছরে তা মাত্রা ছাড়া হয়ে যায় বলে দাবি প্রতিবেশীদের।

নিরঞ্জন মণ্ডল ওই ব্লকেরই একটি বাড়িতে কেয়ার টেকারের কাজ করেন। তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী রুমা ওদের পাশের বাড়ি ২১৯ নম্বরে কাজ করে। আমার স্ত্রীকে একদিন চড় মারে ছেলেটি। সেই সময় পুলিশ ওকে গ্রেফতারও করেছিল।” তাঁর স্ত্রী বলেন, “শেষ দু’বছরে এতটাই বাড়াবাড়ি শুরু হয় যে, কেউ ওদের বাড়ি কাজ করতে যেত না। এ দিকে মায়েরও শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। প্রথম দিকে হোম ডেলিভারিতে খাবার আনাতো। পরে সেই হোম ডেলিভারির লোকজনকে মারধর করায় তারাও আসত না।”

রুমা আরও বলেন, “আমরা সন্দেহ করছিলাম কিছু একটা হয়েছে। কারণ বেশ কিছুদিন ধরে মাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। ছেলে আসবাবপত্র বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল। একদিন লোক ডেকে বাড়ির জলের ট্যাঙ্কটা বিক্রি করে দিল।”

অন্য এক প্রতিবেশী বলেন, “ছেলেটি মাঝে মাঝেই মাকে মারধর করত। আমরা মায়ের কান্নার আওয়াজ পেতাম। কিন্তু ভয়ে কোনও দিন যেতে পারিনি।”

মৈত্রদের গোটা বাড়িটাই এখন একটা ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে। জায়গায় জায়গায় পাঁচিল ভাঙা। রঙ হয়নি বোধহয় বহু বহু বছর। বাড়ির ভিতরেই জমানো আবর্জনা-ময়লা। ট্যাঙ্ক বেচে দেওয়ায় জল নেই এক ফোঁটা। বাথরুম নোংরা। বাড়িতেও জায়গায় জায়গায় মল মূত্র। যদিও প্রতিবেশীদের দাবি, ওই পরিবারের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভাল। মায়ের পেনশন ছিল। বাবাও ভাল টাকাপয়সা রেখে গিয়েছেন।

পুলিশও রীতিমত সংশয়ে গোটা ঘটনা নিয়ে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না কেন মৈত্র মায়ের দেহ নিয়ে রইলেন, কেনই বা হঠাত্ ফোন করলেন পুলিশকে। এক তদন্তকারী বলেন, “প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ছেলেটি নিজেও তা স্বীকার করেছে। ছেলের অভিযোগ, মা ওর পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে দেয়নি। সেই ক্ষোভ এখনও ওর মধ্যে রয়েছে।”

তদন্তকারীদের প্রশ্ন, ছেলেটি তা হলে কেন মায়ের দেহ আগলে রেখে বসেছিল। এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, “আমরা মনোবিদদের সাহায্য নেব মৈত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে।”

প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, গত প্রায় মাসখানেক ধরে বাজার থেকে বিস্কুট মুড়ি কিনে এনে খেয়েছে ছেলে। বাড়িতে রান্না কোনও খাবার পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা ওই পরিবারের কোনও আত্মীয়েরও খোঁজ দিতে পারেননি পুলিশকে। এক তদন্তকারী বলেন, “আমরা ময়না তদন্তের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ ছেলে মাকে খুন করেছে, এই সম্ভবনাও আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না।”

দেহ আগলে রাখার ক্ষেত্রে, রবিনসন কাণ্ডের সঙ্গে এর প্রাথমিক মিল থাকলেও, দুটো ঘটনাকে এক সারিতে ফেলতে রাজি নন তদন্তকারীরা। ২০১৫ সালের ১১ জুন মধ্য কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে তার মাস ছয়েক আগে মৃত দেবযানী দে-র কঙ্কাল উদ্ধার করে শেক্সপিয়ার থানার পুলিশ। একই সঙ্গে উদ্ধার হয় দেবযানীর বাবার অগ্নিদগ্ধ দেহ। উদ্ধার হয় একটি মৃত কুকুরের কঙ্কালও। দিদি দেবযানীর দেহ ছ’ মাস ধরে আগলে ছিলেন ভাই পার্থ দে।

(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন