Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ঘরে টেবিলে ঘুমোচ্ছেন সুন্দরাইয়া, বারান্দায় শুয়ে থাকতেন স্বেচ্ছাসেবক নিরুপম

এ রাজ্যে বাম আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিরুপম সেনের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৮ অক্টোবর। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্ধমান জেলার গোবিন্দপুর অঞ্চলে। সেখানকার রায়পুর হাইস্কুলে তাঁর বাবা ভুজঙ্গভূষণ সেন শিক্ষকতা করতেন। ঐ স্কুল থেকেই নিরুপম সেন স্কুল ফাইনাল পাস করেন।

থেমে গেল লড়াই। প্রয়াত হলেন নিরুপম সেন। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

থেমে গেল লড়াই। প্রয়াত হলেন নিরুপম সেন। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:২৬
Share: Save:

এ রাজ্যে বাম আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিরুপম সেনের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৮ অক্টোবর। তাঁর শৈশব কেটেছে বর্ধমান জেলার গোবিন্দপুর অঞ্চলে। সেখানকার রায়পুর হাইস্কুলে তাঁর বাবা ভুজঙ্গভূষণ সেন শিক্ষকতা করতেন। ঐ স্কুল থেকেই নিরুপম সেন স্কুল ফাইনাল পাস করেন। ১৯৬১ সালে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। সেই সময়েই তিনি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন এবং দ্রুত জনপ্রিয় ছাত্র নেতা হয়ে ওঠেন। ছাত্রাবস্থাতেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তাঁর সদস্যপদের প্রস্তাব করেছিলেন সি পি আই (এম) নেতা মদন ঘোষ এবং সমর্থন করেছিলেন সুশীল ভট্টাচার্য। ১৯৬৬ সালে তিনি বর্ধমান জেলায় ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে তিনি বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়েছেন এবং তার পরে কলা বিভাগেও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

শিক্ষান্তে তিনি প্রথম জীবনে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। প্রথমে বর্ধমানের সি এম এস হাইস্কুলের প্রাতঃবিভাগে এবং তার পরে তিকরহাট হাইমাদ্রাসায়। ১৯৬৮সালে তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। ওই বছরই এপ্রিলে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত হয় মতাদর্শগত প্রশ্নে সিপিএমের কেন্দ্রীয় প্লেনাম। ওই প্লেনামে যেখানে পলিট ব্যুরো সদস্যরা রাত্রিবাস করতেন সেই বর্ধমান ভবনে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিরুপম সেন। ডাইনিং রুমে টেবিলের ওপর চাদর পেতেই শুতেন পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়া ও অন্যান্য পলিট ব্যুরো সদস্যরা। বাইরে বারান্দায় অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে শুতেন নিরুপম সেন।

১৯৬৮ সালেই নাদনঘাটে বর্ধমান জেলার দশম সম্মেলনে নিরুপম সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮৯ সালে রবীন সেন বর্ধমান জেলা কমিটি সম্পাদক পদ থেকে পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এলে বর্ধমান জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পান নিরুপম সেন। সেই থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।

ছয় এবং সাতের দশকের অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় এক অংশে তীব্র কৃষক আন্দোলন এবং অন্য অংশে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। নিরুপম সেন এই আন্দোলনের স্রোতে মিশে গিয়েছিলেন। এর জন্য অন্যান্য সি পি আই (এম) নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা হয়। ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ রাতে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ফেলে দেওয়ার পর দিন যুক্তফ্রন্টের ডাকে সাধারণ ধর্মঘট হয়েছিল। এই সময় ঘটে সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড। সেই মামলাতেও নাম জড়ায় নিরুপম সেনের।

দলীয় জনসভায় নিরুপম সেন। ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন প্রয়াত

সেই সময় বর্ধমানের অনেক সিপিএম নেতার মতোই আত্মগোপন করতে বাধ্য হন নিরুপম। বর্ধমান শহরেই আত্মগোপন করে মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের সাহায্য নিয়ে পার্টি সংগঠনের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর ছদ্মনাম ছিলো ‘বিজন’। এর আগে ছাত্র আন্দোলনের সময়েও তিনি ‘হরিদাস’ ছদ্মনাম নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে রেল ধর্মঘটের সময় অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আত্মগোপনকারী সেই সব কর্মী ও নেতার বর্ধমানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও খাবার সরবরাহের কাজেও নিরুপম সেন সক্রিয় ছিলেন।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি হওয়ার পরে বর্ধমানে পার্টির পুনর্গঠনে শ্রমিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ইত্যাদির আন্দোলনে মধ্যবিত্ত অংশের মানুষকে সংগঠিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী পেয়েছিলেন নিরুপম সেন। সেই তাঁর প্রথমবার বিধানসভায় প্রবেশ। কিন্তু তার পরে তিনি আবার সংগঠনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

১৯৮৫ সালেই নিরুপম সেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন। ১৯৯৫ সালে নিরুপম সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন, জেলা থেকে রাজ্যে বর্ধিত দায়িত্ব নিয়ে আসেন। ১৯৯৮ সালে কলকাতায় দলের ষোড়শ কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।

এ রাজ্যে সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরির প্রথম পর্বে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: বাংলা টেলি সিরিয়ালের জনপ্রিয় মুখ গৌতম দে প্রয়াত

২০০১ সালে নিরুপম সেন ফের বর্ধমান (দক্ষিণ) বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এ বার বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ২০০৬ সালেও তিনি ঐ কেন্দ্র থেকেই পুনর্নির্বাচিত হন। এবারও তিনি শিল্প ও বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রী হন। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে বিদ্যুৎমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। বিধায়ক ও মন্ত্রী হিসাবে বিধানসভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় সমৃদ্ধ বক্তৃতা করার জন্য তিনি যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হিসাবে তিনি রাজ্যের শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। শিল্পায়নের এই দশ বছরের পর্বে কৃষির সাফল্যের ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে কৃষক খেতমজুরদের স্বার্থরক্ষা করে রাজ্যে শিল্প এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টেনে আনায় তিনি দক্ষতার নিদর্শন রেখেছিলেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে টানা আলোচনার মাধ্যমে তেল প্রাকৃতিক গ্যাস, ইস্পাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ আনাতেও তিনি সাফল্য পান। আবার টাটাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে উত্তরাখণ্ড থেকে তাদের অটোমোবাইল প্রকল্প এ রাজ্যের সিঙ্গুরে টেনে আনাতেও তিনি সফল হয়েছিলেন। যদিও শেষপর্যন্ত সিঙ্গুরে আর তা রূপায়িত হয়নি। রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিকাঠামো উন্নয়নে এবং বিদ্যুৎ পর্ষদকে অর্থনৈতিক ভাবে সুদৃঢ় করাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। বামফ্রন্ট সরকারের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে তিনি বহু লেখা লিখেছিলেন। তাঁর লেখা ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘বিকল্পের সন্ধানে’, ‘বর্তমান সময় ও আমাদের পার্টি’, ‘অর্থচিন্তা’, ‘ডাঙ্কেল প্রস্তাব ও ভারতের সার্বভৌমত্ব’, ‘চীনের ডায়েরি’, ‘সময়ের দর্পণে কমিউনিস্ট ইশতেহার’, ‘সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলায়’, ‘প্রসঙ্গ মতাদর্শ’, ‘কেন এই বিতর্ক’, ‘শ্বেত পারাবতের সন্ধানে’, ‘অশান্ত কাশ্মীর’ ইত্যাদি বই জনপ্রিয়।

দলের এক সমাবেশে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: রাহুলের মন বুঝতে ভার ইয়েচুরিকেই

২০১৩ সালে নিরুপম সেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে সুস্থ হলেও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। ফলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে যান। ২০১৫ সালের পার্টি কংগ্রেসে তিনি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হন। অসুস্থ অবস্থাতেও কমরেড নিরুপম সেন হুইল চেয়ারে বসে পার্টির অনেক সভা সম্মেলনে যোগ দিতেন।

এ রাজ্যে বাম আন্দোলন এবং বাম শাসনের ইতিহাস তাঁকে অনেকদিন মনে রাখবে।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া - পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE