এ কালে কলকাতার কাছে ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর আর ‘ফরেন’ নেই। তিন দিনের ছুটিতেও অনেকেই ওই তল্লাটে চলে যাচ্ছেন। শহরের স্বাদ-সংস্কৃতিতেও তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যে জেঁকে বসবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!
চিলি চিকেন-চাউমিনের শহর তাই মাঝেমধ্যেই মৃদু ঝাল গ্রিন কারি-রেড কারির জন্য হাঁকপাঁক করছে। একঘেয়ে সুইট কর্ন স্যুপ বাতিল করে লেবুগন্ধী টলটলে টম ইয়াম স্যুপের জন্য আকুল। কসবার শপিং মলের মাথায় ঝকঝকে রেস্তোরাঁয় বসে তাই মিলতে পারে নারকেলের দুধের থকথকে টম খা সুপ। তাতে খাঁটি শ্যামদেশীয় ধানিলঙ্কা বার্ড চিলির অভিঘাত। বা চিকেন ও নানা কিসিমের সব্জিতে ভরপুর টলটলে ভিয়েতনামী নুড্ল স্যুপ খেতে খেতেও মনে পড়তে পারে গত জন্মের স্মৃতি। আমবাঙালি যখন আবেগে, ‘তোমার নাম আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’ করে উঠত।
তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মায়ানমার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাদগন্ধের ঝাঁপি উপুড় হয়ে পড়ছে কসবার অ্যাক্রোপলিস শপিং মলের আনকোরা রেস্তোরাঁ ‘এশিয়া কিচেন’—এ।
এ দেশের সফল চিনে রেস্তোরাঁ-চেন মেনল্যান্ড চায়না-র কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় সেটা বিলক্ষণ বুঝেছেন। তিনিই ‘এশিয়া কিচেন’-এর রূপকার। বলছিলেন, ‘‘শুধু ঘনঘন যাতায়াতই নয়, বাঙালির রুচির সঙ্গেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভালই মিল। লেবুপাতার গন্ধ, আদার ঝাল, নারকেলের দুধ— এ সব দিয়ে বাঙালি রান্নাও বেশ পুরনো।’’
কেউ কেউ বলেন, চিংড়ির মালাইকারিও না কি আদতে মালয় কারি। পেটের দায়ে মালয়েশিয়ার রবার বাগানে খাটতে যাওয়া দক্ষিণ ভারতীয় মজুরেরা ও দেশে নারকেলের দুধ দিয়ে মাছ রাঁধতেন। মালয় সাগরতীর থেকে সেই মাছই একদিন বাংলায় ঢুকল। এর পরে তার নাম পাল্টে গেল মালাইকারিতে।
শহরের আর একটি জনপ্রিয় চিনে রেস্তোরাঁ-চেন চাউম্যানও ইদানীং উঠতে-বসতে ব্যাঙ্কক-সিঙ্গাপুর করছে। কর্ণধার দেবাদিত্য চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘শ্যামদেশের রান্নার তুমুল চাহিদায় তাইল্যান্ড থেকে টম ইয়াম, মাসামান, গ্রিন বা রেড কারি পেস্ট আসছে।’’ সাউথ সিটি মলে তাই রান্নার বেনজারং-এরও এখন খুব নামডাক। গোলপার্কের আর একটি রেস্তোরাঁ ‘ছন্দা’জ খাউসোয়ে’ আবার কলকাতার ব্রিটিশ আমলের রেঙ্গুন-কানেকশন তুলে ধরতে তৎপর। তুখোড় বার্মিজ রান্না পেশ করতে কর্ণধার ছন্দা দত্ত সেখানে মায়ানমার থেকে স্টিকি রাইস, টি লিভ্স স্যালাডের বিশেষ চা-পাতা বা শুঁটকিবিশেষ গাঁপ্পি আমদানি করছেন।
‘এশিয়া কিচেন’-এ অবশ্য শুঁটকি বা ফিশ সসের তীব্রতা নেই। আমবাঙালির সহ্যক্ষমতা মাথায় রেখে খানিক রদবদল হয়েছে। মেনুতে জাপানি সুশিও কাঁচা নয়। অতি উপাদেয় ক্যালিফোর্নিয়া রোল। মোজারেলায় বেক করা হয়েছে। কাঁকড়ামাংসের সুশির সঙ্গতে ওয়াসাবিকেও মেয়োনিজযোগে অনেকটা পোষ মানানো হয়েছে। ফিউশন রান্না মুচমুচে ডিনামাইট চিংড়িতে শ্যামদেশীয় ঝাল-মিষ্টি ‘শ্রীরাচা সস’ মিশিয়েও একটা চেনা কন্টিনেন্টাল আদল আনা হয়েছে। খেতে-খেতে পার্ক স্ট্রিটের প্রন ককটেলকে মনে পড়ে যায়।
কিন্তু ভিয়েতনামী চিকেন স্প্রিংরোলের জন্য বিশেষ ময়দার খোল, মালয়দেশীয় মশলাদার মাছের ঝোলের তালগুড়, মাছভাজার টেম্পুরা ব্যাটার, লেমন গ্রাস, লঙ্কা থেকে অনেক কিছুই খাস ব্যাঙ্কক-সিঙ্গাপুর থেকে ঢুকছে বলে দাবি এশীয় হেঁসেলের কর্তাদের। আর আছে লিচুর জাতভাই তাইল্যান্ডের ফল রামবুটান। কলকাতার শীতে এই অসময়ের ‘লিচু’র আবেশ আইসক্রিমযোগে মন্দ লাগছে না।
তবে গত দু’এক বছরে কলকাতায় দু’একটি দুর্ঘটনাও ঘটেছে। ফোরামে জাপানি খানার রেস্তোরাঁ মাতসুয়ো বা রাসবিহারীর মোড়ে তাই-মালয় রান্নার ঠেক ‘দ্য স্ট্রেটস’ অকালে ঝাঁপ বন্ধ করেছে। শহরের নতুন রেস্তোরাঁর ফর্মুলায় তবু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই দাপট। পাঁচতারা হোটেলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে স্ট্যান্ড-অ্যালোন রেস্তোরাঁর মেনুতেও যা এক অনিবার্য আইটেম হয়ে উঠেছে।