শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
মাথার উপরে উন্মুক্ত নীল আকাশ, রাস্তা পেরোলেই সবুজের আচ্ছাদনে ঢাকা রবীন্দ্র সরোবর আর বিবেকানন্দ পার্কের ধার ঘেঁষা ঝকঝকে পাড়া যতীন বাগচী রোড। সাদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে পাড়াটা গিয়ে মিশেছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে। পাড়ার খুব কাছেই কেয়াতলা রোড, পূর্ণদাস রোড।
এ পাড়ায় এসেছি ১৯৭৬-এ। এখানে এসে প্রথমে কিন্তু মন ভরেনি। প্রথম প্রথম এ জায়গাটাকে তো নিজের পাড়া বলেই ভাবতে পারতাম না। কারণ, তখন পাড়া মানে জানতাম উত্তরের বলরাম ঘোষ স্ট্রিট। সেই পুরনো বাড়ি, সরু গলি। সেখানেই জন্ম, কেটেছে শৈশবও। আজও মনে পড়ে চুয়া, পিকা, অপু, বিভূ, জয়ন্তর মতো বন্ধুদের কথা।
এ পাড়ায় এসে প্রথমে একটু হকচকিয়েই গিয়েছিলাম। এ কেমন পাড়া! কেউ কারও ব্যাপারে মাথা ঘামান না, বরং সকলেই নিজের মতো থাকতে পছন্দ করেন। উত্তরের সেই জমজমাট ব্যাপারটাও নেই। মনে হত এখানে সম্পর্কের উষ্ণতা অনেক কম। তার উপরে এ পাড়ার সুন্দরী মেয়েরা শুধু ইংরেজিতেই কথা বলত। আজ চল্লিশ বছর এখানে কাটিয়ে উপলব্ধি করি, আমার অস্থিমজ্জায় কতটা মিশে গিয়েছে এই পাড়া আর তার জীবনযাত্রা।
সম্পর্কের কথাই যদি বলি, সময়ের সঙ্গে সেটা বরং দৃঢ় হয়েছে, ক্ষীণ হয়নি। সময়ের অভাবে রোজ দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও, দরকারে এক ডাকেই সকলকে পাশে পাওয়া যায় এখানে। রয়েছে পাড়া-পড়শির মধ্যে সুসম্পর্ক। পাড়ার প্রতি বেশি টান অনুভব করি যখন দীর্ঘদিন পাড়াটাকে ছেড়ে বিদেশে থাকি। ফিরে এলেই অনুভব করি অদ্ভুত এক শান্তি। তাই যত দিন যাচ্ছে পাড়ার আকর্ষণ বেড়ে চলেছে আমার কাছে।
সেই সময়ে আমাদের আবাসনটাই ছিল পাড়ার একমাত্র বহুতল। তখন বারান্দা থেকেই দেখা যেত সামনের লেক। গাছগাছালির সংখ্যাও ছিল এখনকার চেয়ে কম। পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ি ছিল একতলা, বড়জোর দোতলা। পাড়ায় দোকান বলতে ছিল একমাত্র সুধীরবাবুর দোকান। সেখানেই মিলত প্রয়োজনীয় সব কিছু। সেই দোকানটা আজও আছে। আজ যেখানে বিবেকানন্দ পার্ক সেখান থেকে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্স পর্যন্ত ছিল ইংরেজদের মিলিটারি হাসপাতাল। পরে হাসপাতাল ভেঙে তৈরি হয় পার্ক। ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে এ পাড়ায় মাত্র চার-পাঁচটি বাড়ি ছিল। বাকি সব বাড়ি তৈরি হয়েছে পরে।
এখন ফ্ল্যাটের সংখ্যাই বেশি। একে একে পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল তৈরি হওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে পাড়ার বেশির ভাগ একান্নবর্তী পরিবার। তাই সদস্য সংখ্যাও কম। মাঝেমাঝে পাড়াটাকে মনে হয় একটা বৃদ্ধাশ্রম। পাড়ার যুব সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই পড়াশোনা কিংবা চাকরি সূত্রে বিদেশে।
জমি ও ফ্ল্যাটের বাড়তে থাকা দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই মধ্যবিত্ত এই পাড়াটায় এসেছেন উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি, এমনকী অবাঙালিরাও। তবু আজও পাড়াটা হাবভাবে ষোলো আনাই বাঙালি। এখনও পাড়ার পুজোকে কেন্দ্র করে মিলিত হন সকলে। চলে আড্ডা, আলোচনা, হইচই। কালীপুজোর সময়ে পাড়ায় একটা গানের জলসাও হয়।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
কাছেই রবীন্দ্র সরোবর। এ পাড়ায় আসার পরে নিয়মিত প্রাতর্ভ্রমণে যেতাম। যেতেন আমার বাবাও। এখন সারা বছরে দু’-তিন দিনও ওখানে যাওয়ার সময় পাই কি না সন্দেহ। আগে পাড়ার মানুষের আড্ডার জায়গা ছিল রবীন্দ্র সরোবর আর বিবেকানন্দ পার্ক। এখন সময়ের অভাবে আড্ডার ছবিটাই বদলে গিয়েছে। এখন কিছু মানুষকে দেখি রবীন্দ্র সরোবরে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে ক্ষণিকের আড্ডাটা সেরে ফেলেন।
বিবেকানন্দ পার্ককে ঘিরে এ পাড়ায় খেলাধুলোর চল আগের চেয়ে বেড়েছে। তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ক্রিকেট ও ফুটবল কোচিং ক্লাব। তবে শুধু খেলাধুলো নয়, বিবেকানন্দ পার্কের বাইরেও একটা বড় আকর্ষণ আছে। ফুচকা, ভেলপুরি কিংবা চাটের দোকানগুলি। এগুলির টানেই সন্ধ্যা থেকে এখানে ভিড় জমান অনেকে। বছর দশেক আগে এক সন্ধ্যায় আচমকাই বারান্দায় গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। দেখি, আলোয় ঝলমল করছে বিবেকানন্দ পার্ক।
সময়ের সঙ্গে সত্যিই উন্নতি হয়েছে এই এলাকার। রাস্তায় আলো আর নিয়মিত সাফাইয়ের জন্য চারপাশ ঝকঝকে থাকে। এলাকাবাসীদের মধ্যে পাড়াটাকে পরিষ্কার রাখার সচেতনতা রয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বাসিন্দাদের নিয়ে একটা ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করলেও মন্দ হয় না।
পাড়ার কথা লিখতে বসে বারবার মনে আসছে অতীতের কথা। এখনও মাঝেমাঝে গভীর রাতে মনে পড়ে হারমনিয়ামে উদাস একটা সুর বাজিয়ে হেঁটে যাওয়া সেই মানুষটির কথা। এক দিন আচমকাই তিনি হারিয়ে গেলেন। তবু কানে লেগে আছে সেই সুর। সময়ের সঙ্গে অনেক বদলেছে আমার পুরনো পাড়াটা। কিন্তু এখানেই তো প্রকৃতিকে নানা ভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছি। চল্লিশ বছরে নিজের অজান্তেই ঝাপসা হয়ে এসেছে ছেলেবেলার এলাকা, ভালবেসে ফেলেছি এই পাড়াটাকেই।
লেখক সঙ্গীতশিল্পী