রূপটানের নীচেই ক্ষয়রোগ

রেলিংয়ে রঙের পোঁচ, রাস্তায় পিচের প্রলেপ। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোয় পড়ে না নজর। এ ভাবেই এক বিপর্যয়ের পরে আসে আর এক বিপর্যয়। কোন ‘সেতুশ্রী’র কী হাল, খোঁজ নিলেন সোমনাথ চক্রবর্তী, অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া।উপরের সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে নীচের ভগ্নদশা কারও নজরে পড়লে মাঝেরহাট বা পোস্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। আরও দেখা গেল, সেতু লাগোয়া একটি ভাতের হোটেলের সামনে গোটা পাঁচেক ইঁদুরের গর্ত।

Advertisement

সোমনাথ চক্রবর্তী ও অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া।

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:২১
Share:

হাল-হকিকত: বাঘা যতীন উড়ালপুলের পাশে চলছে মেট্রোর কাজ। তার ভারী যন্ত্রপাতি রাখা উড়ালপুলের উপরেই (চিহ্নিত) । ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল, দেশকল্যাণ চৌধুরী ও বিশ্বনাথ বণিক

বাঘা যতীন উড়ালপুল: ইএম বাইপাসের উপরে এই উড়ালপুল দিয়ে চলাচল করা গাড়ির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় ২০ বছরের পুরনো বাঘা যতীন উড়ালপুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রাইটসকে নিয়োগ করেছিল রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা কেএমডিএ। বছরখানেক আগে তারা রিপোর্ট দেয়। কিন্তু সেই মোতাবেক কাজ হয়নি। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, উড়ালপুলের গার্ডার অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ১৫ বছর অন্তর যে বেয়ারিং পাল্টাতে হয়, তা-ও করা হয়নি। ফলে বহন-ক্ষমতা কমছে উড়ালপুলের।
পাশাপাশি, ওই উড়ালপুলের গা-ঘেঁষে চলছে নিউ গড়িয়া-দমদম বিমানবন্দর মেট্রোর কাজ। তার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রাখা রয়েছে উড়ালপুলের উপরেই। বুধবার গিয়ে দেখা গেল, চলছে সংস্কারের কাজ। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে।’’ কেএমডিএ-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার আশিস সেন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ফোনে পাওয়া যায়নি পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকেও।

Advertisement

বেলেঘাটা সেতু: উপরে পিচের মসৃণ রাস্তা। দু’ধারের বিদ্যুৎ-স্তম্ভে এলইডি এবং বাহারি আলো। রেলিংয়ে নীল-সাদা রং। প্রতি মিনিটে ছুটছে অন্তত ২০-২৫টি ছোট-বড় গাড়ি, এমনকি যাত্রিবাহী বাসও। অথচ যে কাঠামোর উপরে দাড়িয়ে সেতুটি, তার একাধিক বিম উধাও! লোহার গার্ড খুবলে খাওয়া। নীচের কাঠামোর একটি বড় অংশের পলেস্তারা খসে মরচে ধরেছে লোহায়। সেতুর গায়ে থাকা ফলক বলছে, ‘সিআইটি, ১৯২৯’। অর্থাৎ, প্রায় ৯০ বছর বয়স এই সেতুর।

বেলেঘাটা সেতুতে পলেস্তারা খসে বেরিয়ে এসেছে মরচে ধরা লোহা। কোথাও আবার আস্ত বিম গিয়েছে চুরি (চিহ্নিত)।ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল, দেশকল্যাণ চৌধুরী ও বিশ্বনাথ বণিক

Advertisement

স্থানীয়দের বক্তব্য, উপরের সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে নীচের ভগ্নদশা কারও নজরে পড়লে মাঝেরহাট বা পোস্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। আরও দেখা গেল, সেতু লাগোয়া একটি ভাতের হোটেলের সামনে গোটা পাঁচেক ইঁদুরের গর্ত। হোটেল মালিকের কথায়, ‘‘ইঁদুরেরা খাবারের খোঁজে আসে। আবার সেতু কাটতেও।’’ কিন্তু লোহার কাঠামো উঠে গেল কী ভাবে? হোটেলের এক কর্মী জানালেন, মাদকাসক্তদের ‘উপদ্রব’ রয়েছে। কিছু না পেয়ে লোহা কেটে নেয় তারা। ২০১৪ সালে ধাপা জলপ্রকল্পের পাইপলাইন পাতার সময়ে এই সেতুর দুরবস্থা নজরে আসে কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষের। সে খবর জানানো হয়েছিল কেআইটি-কে। কিন্তু চার বছর কেটে গেলেও হাত পড়েনি সংস্কারে।

আরও খবর: গ্রামে প্রস্তুত কনে, শহরে ধ্বংসস্তূপের তলায় প্রণব​

করুণাময়ী সেতু: সেতুর মাঝ বরাবর ফাটল। টালি নালার উপরে যে দু’টি স্তম্ভে ভর করে সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে, ফাটল ধরেছে সেখানেও। এর উপরে বট-অশ্বত্থ শিকড় চালিয়েছে বহু আগেই। বাসিন্দাদের দাবি, সেতুটি তৈরির পরে সে ভাবে কখনও সংস্কারের কাজ হয়নি। ফলে প্রায় ৩৫ বছরের পুরনো এই সেতুর মেয়াদ আর কত দিন, আরও কত গাড়ির ভার সে রোজ নিতে পারবে— সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে উঠেছে।

করুণাময়ী সেতুর নীচে ফাটল। বুধবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল, দেশকল্যাণ চৌধুরী ও বিশ্বনাথ বণিক

টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে টালি নালা হয়ে হরিদেবপুর পৌঁছতে আশির দশকে করুণাময়ী সেতু তৈরি করেছিল কেএমডিএ। সেতুর নামকরণ নিয়ে দুই দলের টানাপড়েন থাকায় সরকারি ভাবে কোনও ফলক নেই। ফলে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার, স্পষ্ট নয় কারও কাছে।

আরও খবর: অনেক দিনের ‘ক্লান্তি’ অসহ্য হতেই মাঝেরহাটে এই বিপর্যয়!

স্থানীয় ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের দাবি, বছর পাঁচেক আগে সেচ দফতর টালি নালা সংস্কারের সময়ে সেতুর দু’পাশের স্তম্ভ সারাই করেছিল। তা ছাড়া তেমন বড় মেরামতির কাজ হয়নি বললেই চলে। পূর্ত দফতরের এক আধিকারিক বলছেন, ওই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁদের নয়। সেই দায়িত্ব পুরসভার। পুরসভার পাল্টা দাবি, দায়িত্ব তাদেরও নয়। তা হলে কার? উত্তর মিলছে না।

(আগামী কালের ‘সেতুশ্রী’রা: টালা সেতু, অরবিন্দ সেতু, চিংড়িঘাটা উড়ালপুল, শিয়ালদহ উড়ালপুল ও অম্বেডকর সেতু)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন