অসুস্থতার বাধা টপকেই সাফল্য 

মনের জোর ধরে রেখে অস্ত্রোপচারের দু’দিন পরে পরীক্ষাকেন্দ্রে যায় সে। প্রতিটি পরীক্ষা দিতে হয় শুয়ে।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০০:৪১
Share:

কৃতী: ইশর নির্মল

আইসিএসই-র তখন সপ্তাহ দেড়েক বাকি। দেখা গেল, বসতেই পারছে না ছেলেটি। বেশ কিছু দিন ধরেই মলদ্বারের কাছে টিউমার হয়ে শিরদাঁড়ার নীচের অংশে খুব

Advertisement

যন্ত্রণা হচ্ছিল। দিন দিন তা মারাত্মক আকার নেয়। চিকিৎসক জানান, অপেক্ষা করার সময় নেই। অস্ত্রোপচার করতে হবে পরীক্ষার আগেই। এমন অবস্থায় পরীক্ষায় আর বসা হবে কি? তৈরি হয়েছিল সংশয়। তবু মনের জোর ধরে রেখে অস্ত্রোপচারের দু’দিন পরে পরীক্ষাকেন্দ্রে যায় সে। প্রতিটি পরীক্ষা দিতে হয় শুয়ে। কোনও ভাবে পাশ করে যেতে পারলে, বছরটা আর নষ্ট হবে না— এটাই ছিল

একমাত্র ভাবনা। আইসিএসই-র ফল প্রকাশ হতে দেখা গেল, ইশর নির্মল নামে সেই ছাত্রই পেয়েছে ৯২.৬ শতাংশ নম্বর!

Advertisement

ইশরের বাবা, পেশায় ব্যবসায়ী পবনকুমার নির্মল একমাত্র সন্তানের অসুস্থতা ঘিরে দুশ্চিন্তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখনও। একটাই ভাবনা, ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে হবে যে কোনও উপায়ে। প্লাইলোনাইডাল সাইনাসের যন্ত্রণা আর আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে। বৃহস্পতিবার তিনি জানালেন, পরীক্ষার আগে কোনও ভাবেই অস্ত্রোপচার করাতে চায়নি ইশর। এত দিন ধরে প্রস্তুতি নেওয়ার পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে যে পিছিয়ে পড়তে হতে পারে, তা মেনে নিতে পারছিল না বছর ষোলোর এই কিশোর। কিন্তু চিকিৎসক বলেছিলেন, এখনই অস্ত্রোপচার না হলে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা শিরদাঁড়ায়। শল্য চিকিৎসক সতীশপ্রসাদ বাঙ্কা অস্ত্রোপচার করেছেন ইশরের। এ দিন তিনি বললেন, ‘‘পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে অস্ত্রোপচার করলে দেরি হয়ে যেত। এই অসুখে সংক্রমণটা খুব তাড়াতাড়ি হাড়ে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’’

এখনও আরও মাস দুয়েক লাগবে ইশরের সুস্থ হতে। ছেলে আগের মতো হেঁটেচলে বেড়াতে পারলে তবেই তার সাফল্যের আনন্দটা উপভোগ করতে পারবেন বলে জানালেন বাবা। তিনি বলেন, ‘‘ও ৬০-৭০ শতাংশ নম্বর পেলেও খুশি হতাম। গত কয়েক মাস ধরে আমার ছেলের যে কী কষ্ট যাচ্ছে, তা চোখে দেখা যায় না!’’

বাগুইআটির ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুলের ছাত্র ইশর পড়াশোনায় বরাবরই ভাল বলে জানালেন শিক্ষকেরা। তবে সঙ্কটের সময়ে এমন ফল হওয়ায় তাকে নিয়ে রীতিমতো গর্বিত স্কুল। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল মৌসুমী সাহা এ দিন জানান, পরীক্ষার ক’দিন আগে এই বিপদের কথা জেনে চিন্তায় পড়েছিলেন তাঁরাও। কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী ‘স্টুডেন্ট উইথ স্পেশ্যাল ডিফিকাল্টি’-র কিছু সুবিধে প্রাপ্য। ইশরের মেডিক্যাল রিপোর্ট-সহ সেই সুবিধের জন্য আবেদন করা হয় স্কুলের তরফে। কাউন্সিল তা গ্রাহ্য করায় দু’ঘণ্টার পরীক্ষার ক্ষেত্রে আরও এক ঘণ্টা বেশি সময় পেয়েছে ইশর। আলাদা একটি ক্লাসঘরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছে সে। প্রিন্সিপাল বলেন, ‘‘টানা তিন ঘণ্টা ও ভাবে থাকা সহজ কথা নয়। ইশরের মনের জোর আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে রইল।’’

ইশর অবশ্য বলছে, এই মনের জোর সে পেয়েছে বাবা, বন্ধু ও শিক্ষকদের থেকেই। সে বলে, ‘‘পরীক্ষা দেব না, প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলাম। বন্ধুরাই বলে, এক বার বসে দেখতে। স্কুলের শিক্ষকেরাও জানতে পেরে একই পরামর্শ দেন। তাই সাহস পেলাম।’’ সে জানায়, রোজ সকালে অস্ত্রোপচারের জায়গায় ড্রেসিং করতে হত। তার পরে গাড়িতে শুইয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতেন বাবা। অনেকে মিলে ধরে ধরে একতলার ক্লাসঘর পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতেন তাকে। ছোটবেলায় মা হারানো ছেলেটি এ দিন বলছিল, এমবিএ বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়ার ইচ্ছে তার। এর প্রস্তুতি নিতেও অনেক সময়ে এক-আধ বছর সময় দিতে হয়। ফলে এ বছরটা নষ্ট হলে খুবই ক্ষতি হয়ে যেত বলে মনে করে সে।

একাদশ শ্রেণির ক্লাস ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। বাবা তার ভর্তির ব্যবস্থাও করে এসেছেন পুরনো স্কুলের কমার্স বিভাগে। পড়াশোনা আর বন্ধুদের মাঝে ফেরার অপেক্ষায় এখন কিশোর মনটা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন