শরৎ ব্যানার্জি রোড

ঝকঝকে-ঝলমলে, তবু প্রাণের তারে সুর বাজে না

আমার পাড়া আজ আর আমার নেই। ১০ নম্বর শরৎ ব্যানার্জি রোডের এই অঞ্চল এখন নামী-দামি রেস্তোরাঁ আর হাইরাইজের দম্ভে বড় বেশি কঠিন, অচেনা। গরমের ছুটি, পাড়াভর্তি দামাল ছেলেগুলো সব ভ্যানিশ। তাদের ক্রিকেটের বলে আজ তেমন জোর নেই যে, তা বাড়ির কাচ ভেঙে ফেলবে। পাড়াটা ক্রমশ সেজে উঠছে কফিশপের স্বচ্ছ কাচ-এ। ক্লাব কালচার এখন ক্যাফে কালচারে পরিণত হয়েছে। পাড়ার সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম আজ আর চোখে পড়ে না। আজকের সংস্কৃতি গিটারে এসে থেমেছে। হারমোনিয়ামের সুর বুঝি আজ সেকেলে।

Advertisement

সুদেব গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০০:৩০
Share:

আমার পাড়া আজ আর আমার নেই। ১০ নম্বর শরৎ ব্যানার্জি রোডের এই অঞ্চল এখন নামী-দামি রেস্তোরাঁ আর হাইরাইজের দম্ভে বড় বেশি কঠিন, অচেনা। গরমের ছুটি, পাড়াভর্তি দামাল ছেলেগুলো সব ভ্যানিশ। তাদের ক্রিকেটের বলে আজ তেমন জোর নেই যে, তা বাড়ির কাচ ভেঙে ফেলবে। পাড়াটা ক্রমশ সেজে উঠছে কফিশপের স্বচ্ছ কাচ-এ। ক্লাব কালচার এখন ক্যাফে কালচারে পরিণত হয়েছে। পাড়ার সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম আজ আর চোখে পড়ে না। আজকের সংস্কৃতি গিটারে এসে থেমেছে। হারমোনিয়ামের সুর বুঝি আজ সেকেলে।

Advertisement

ঘটনাসূত্রে আমার তিন পাড়া। বাবা-কাকাদের প্রায় তিরিশ জনের যৌথ পরিবারে আমি মানুষ। আর আমার জন্ম-পাড়া বালিগঞ্জ প্লেস। ৩৮ নম্বর ঠাকুরতা হাউজে তখন হইহই করে কেটে গিয়েছিল অনেক বছর। পাড়াটা ছিল বাড়িরই একটা অঙ্গ।

লোক বাড়ার চাপ আমাদের পরিবারেও দেখা দিল। আমরা বাসস্থান বদল করলাম। চলে এলাম ডক্টর কালিদাস নাগের রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়ির একতলায়। তখন এই পাড়া ছিল খেলার পাড়া। রাস্তা দখল করে পাড়ার ছেলেরা চুটিয়ে ক্রিকেট খেলত। ক্রিকেট বলের দাপটে একের পর এক বাড়ির কাচ ভাঙত। শত বকুনি সত্ত্বেও খেলা থামেনি। অথচ আজ সে খেলাও নেই। বকুনিও নেই। হারিয়ে গিয়েছে প্রচুর গাছও। ছায়ার বড় অভাব।

Advertisement

সত্তরের দশকেই বসন্ত রায় রোড ছেড়ে তার ঠিক পাশের পাড়া শরৎ ব্যানার্জি রোডে আমরা চলে আসি। এখনকার পাড়ায় প্রতিবেশীরা যেমন কেউ কাউকে চেনে না বা হাসলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তখন তেমন ছিল না। বহু বিখ্যাত ও দিকপাল ব্যক্তিত্ব তখন ওই পাড়ায় থাকতেন। বিখ্যাত চিত্রকর পরিতোষ সেন, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ চিন্ময় ও উমা সেহানবীশ, সুচিত্রা মিত্রের তৎকালীন বাসগৃহ—সবই একশ গজের মধ্যেই ছিল। চাইলেই আমরা যে কেউ যে কারওর বাড়ি গিয়ে হাজির হতাম। মোবাইল ফোনে টেক্সট মেসেজ করে আসতে হত না। এঁদের মধ্যে পরিতোষদা ও সুভাষদার পরিবারের সঙ্গে আমাদের সখ্য ছিল বেশি। টিভি-তে কোনও খেলাধুলো হলেই এঁরা দু’জন খেলা দেখতে আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। খেলার সঙ্গে সঙ্গে বেশ আন্তরিক আড্ডাও বসত। পরিতোষদা ও বৌদির আমাদের পুত্র-কন্যার সঙ্গে এক অমলিন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমার ভাইঝি শ্রেয়াকে ওঁরা নাতনির মতো স্নেহ করতেন। প্রতি দিন বিকেলে শ্রেয়ার ডাক পড়ত বৌদির কাছ থেকে। নিজের হাতে বৌদি রোজই ওকে সাজিয়ে দিতেন। ভারী সুন্দর ছিল তখন আমাদের পাড়ার পরিবেশ।
মনে হত, গোটা পাড়াটাই যেন একটা বাড়ি। ‘ভ্রাতৃ-বৃন্দ’ নামক একটি ছোট্ট পুজো কেন্দ্রিক ক্লাব ছিল। নতুন জামা কাপড় পরে সেখানে জড়ো হতাম আমরা। আজও আছে সেই ‘ভ্রাতৃ-বৃন্দ’।

বেশ কিছু দিন হল, এই পাড়া থেকে লোডশেডিং বিদায় নিয়েছে। লন্ঠন বাতির ঝিমধরা আলোর বদলে পাড়ার রাস্তায় আজ নরম সাদা আলো। বেশ স্নিগ্ধ, শান্ত একটা ভাব আছে এই আলোর। জল নিয়ে কোনও দিনই অসুবিধায় পড়তে হয়নি শরৎ ব্যানার্জি রোডের বাসিন্দাদের। আজও জলের ভাগে টান পড়ে না। তবে আগে চাপা কল থেকে গঙ্গার জল এসে হোসপাইপ দিয়ে পাড়ার সব রাস্তা স্নান করত। জল পেয়ে রাস্তাগুলো কেমন ঝকমক করত। সেই রাস্তাস্নান আজ আর চোখে পড়ে না। তবে প্রচুর ঝাড়ুদার দেখতে পাই। যারা দিনে দু’ তিন বার জঞ্জাল সাফ করে পাড়াকে ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। এটা কিন্তু উপভোগ করি।

পাড়া দেখতে ভাল হলেও তার চেহারা ক্রমশ বদলাচ্ছে। তখন লেক মার্কেটের বাজারে গেলেই দেখা হয়ে যেত কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমাদের পাড়ার ঠিক পাশেই লেক টেম্পল রোডে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। পরবর্তী কালে ওই বাড়িতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। এখন সেই সব দিকপাল ব্যক্তির অনুপস্থিতি ভীষণ চোখে পড়ে। পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে তাবড় তাবড় ফ্ল্যাট। যা বাঙালির নাগালের বাইরে। মিস করি বাঙালি আর তার পাড়া-সংস্কৃতিকে। আরও একটা জিনিসও খুব বলতে ইচ্ছে করছে, বাঙালিদের মতো অমন পাড়ার প্রেম কেউ করতে পারে না। প্রেম টিঁকল কি টিঁকল না সেটা বিষয় নয়। তবে ওই যে, এ বাড়ির বারান্দার ফাঁক থেকে ও বাড়ির ছাদের দুপুরের উঁকি, চোখাচোখি। সেই লুকোছাপা পাড়া-প্রেমের আমেজটাই কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আজকের ফেসবুক আর ওয়্যাটস্অ্যাপ। আসলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেলাধুলো বা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম প্রায় উঠেই গিয়েছে। এটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। আজও এ পাড়াতেই কখনও সখনও দেখা মেলে সুন্দরী মধ্যবয়সী ‘সাউথ নন্দিনী’দের।

লেখক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement