মনের ক্ষত কেন আড়াল করে মেধা আর বুদ্ধিকে? কী বলছেন মনোবিদরা

কারও মনে তোলপাড় চলছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে মন। অথচ তার মেধা ও বুদ্ধি হয়তো সেই অবস্থাকে সামনেই আসতে দিচ্ছে না। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ কিছু লিখছে, সেখানেই সে মানসিক অস্থিরতার বিশেষ চিহ্ন রেখে যাচ্ছে।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯ ০১:০৩
Share:

বন্ধুদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে। গল্পগুজব করছে। সামাজিক আচরণে আপাতদৃষ্টিতে কোনও অসঙ্গতিও নেই যা চট করে ধরা পড়বে সাধারণ চোখে। কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই সে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। কমবয়সিদের মানসিক অবসাদ এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাহ্যিক জীবন ঢেকে রাখছে তাদের ক্ষতবিক্ষত মনকে। তৈরি হচ্ছে এক জটিল পরিস্থিতি, যেখানে তাদের সাফল্যমুখী ‘পারফরম্যান্স’ ঢেকে দিচ্ছে মনের তোলপাড়, আত্মহত্যাপ্রবণতা। ফলে বাবা-মায়েদের কাছে ক্রমশ ‘অচেনা’ হয়ে উঠছে নিজেদের সন্তান। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, হাসিঠাট্টার মধ্যে লুকিয়ে রাখা যে আত্মনিধনের বীজ, তার উৎস কোথায়, কী ভাবেই বা তাকে চিহ্নিত করা যাবে?

Advertisement

মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম মনে করেন, কেন কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তা আগাম বলাটা সব সময়েই খুব মুশকিল। এই ‘ধোঁয়াশা’ কাটাতে সন্তানের সঙ্গে মনের সংযোগ তৈরি করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা-মাকে বাচ্চাদের এই আশ্বাসটা দিতে হবে, যত খারাপই পরিস্থিতি হোক না কেন, সেটা সন্তান যেন তাঁদের অবশ্যই জানায়! মনের পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, যতই বিপদ আসুক, আত্মহত্যা কোনও পথ নয়, এটা নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলার সময় এসেছে।’’

পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে মেধা ও মনের মধ্যে লড়াইয়ে। যেখানে ক্ষতবিক্ষত মনকে ঢেকে রাখে মেধা বা বাহ্যিক জীবনের ‘ভাল পারফরম্যান্স’। সেই ‘বাহ্যিক পারফরম্যান্স’ দেখেই অনেক বাবা-মা আশ্বস্ত বোধ করেন যে সব কিছু ঠিকই আছে, কিন্তু আদতে তা নয় বলে জানাচ্ছেন মনোরোগ চিকিৎসক প্রথমা চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘কারও মনে তোলপাড় চলছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে মন। অথচ তার মেধা ও বুদ্ধি হয়তো সেই অবস্থাকে সামনেই আসতে দিচ্ছে না। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ কিছু লিখছে, সেখানেই সে মানসিক অস্থিরতার বিশেষ চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। ফলে ‘ডিরেক্ট কমিউনিকেশন’-এর পাশাপাশি ‘ইনডিরেক্ট কমিউকেশন’-এর দিকেও নজর দিতে হবে।’’

Advertisement

কিন্তু সেই নজর দেওয়ার ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে। কারণ, পড়াশোনার পাশাপাশি সন্তানকে একাধিক ‘এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি’-র সঙ্গে যুক্ত করেন বাবা-মায়েরা। শুরু হয় সারাদিন ধরে দৌড়। মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যান্যালের সতর্কবার্তা, ‘‘দৌড়তে গিয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে ভাল করে তাকানোই হচ্ছে না! কিন্তু সন্তানদের কথাবার্তায় কোনও পরিবর্তন আসছে কি না, ভাষার ব্যবহার পাল্টাচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখতে হবে।’’

সন্তানের পাশাপাশি বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ বিষাদগ্রস্ত থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও চিকিৎসা করানো জরুরি বলে মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়। কারণ, না হলে সেই বিষাদের প্রভাব পড়তে পারে সন্তানের উপরেও। ‘‘দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা সেই প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন না। এ বিষয়ে বললে তাঁরা সহযোগিতা করেন না!’’ বলছেন রিমা।

শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, প্রাপ্তবয়স্কেরাও নিজেদের ক্ষতবিক্ষত মনকে প্রকাশ্যে আনেন না বলে জানাচ্ছেন কবি জয় গোস্বামী। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ কখন আত্মধ্বংস করবেন, সেটা তিনি সমাজের সামনে লুকিয়ে রাখেন। কারণ, তিনি যদি কখনও প্রকাশ করেন, ‘আমি আত্মহত্যা করতে চাই’, লোকে সেটা হুমকি মনে করেন ও বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তাঁকে বোঝার, পাশে দাঁড়ানোর, কথা শোনার এক জন মানুষও যদি থাকেন, তা হলে এমন ঘটনা ঘটে না!’’

বিষাদ-গ্রহ থেকে বেরোনো আসলে দ্বিপাক্ষিক একটি প্রক্রিয়া, দ্বিমুখী পথ। এখানে এক পক্ষের নয়, দু’পক্ষের চেষ্টাতেই ‘ধোঁয়াশা’ কাটানো সম্ভব। সে ভাবেই আত্মনিধনের বীজ দূরে রাখা যায় বলে জানাচ্ছেন সকলে।

প্রথমা চৌধুরী (মনোরোগ চিকিৎসক)

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন