এমনই হাল শহরের অধিকাংশ সুলভ শৌচালয়ের। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
সুলভের গেটে দাঁড়িয়ে দশ-বারো জন ফুটপাথবাসী। তাঁদের ঠেলে ভিতরে ঢুকে বোঝা গেল না কোনটা মহিলাদের শৌচাগার। ভদ্রমহিলাকে একটু অবাক চোখেই দেখলেন দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। পরে জিজ্ঞাসা করতে তাঁদেরই এক জন দেখিয়ে দিলেন মহিলাদের শৌচাগারের দরজা। ভিতরে ঢুকতেই মেঝেতে থইথই জল। অনেক জায়গায় সিমেন্টের প্রলেপ উঠে গিয়েছে। পা বাড়াতেই গন্ধে আপনা থেকেই নাকে রুমাল চাপা দিতে হল। সিআইটি রোডে রামলীলা মাঠ সংলগ্ন সুলভ শৌচাগারে এটাই বৃহস্পতিবারের ছবি। যদিও সেখানকার সাফাইকর্মী জানালেন, দিনে দু’বার তিনি ওই শৌচাগারটি পরিষ্কার করেন।
কিন্তু এই সুলভটি ব্যবহার করেন কারা? ওই সাফাইকর্মীর দাবি, পথচলতি অফিসযাত্রী থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই ওই শৌচাগার ব্যবহার করেন। যদিও আশপাশের দোকানিরা বলছেন, এই সুলভটি শুধুমাত্র ফুটপাথবাসীরাই ব্যবহার করেন। অন্য কেউ এখানে ঢোকেনই না।
এনআরএসের গেটের বাইরে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের উপরেও রয়েছে একটি সুলভ। সেখানে ঢুকতে হবে নোংরা জল ডিঙিয়ে। এতটাই দুর্গন্ধ যে, স্বাস্থ্যসচেতন কেউই সেখানে ঢুকবেন না। আর তা যে সত্যিই ঢোকেন না, সে কথা জানালেন কাউন্টারে থাকা ব্যক্তি। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নিয়োগ করা ওই ব্যক্তি জানালেন, এই সুলভটি মূলত ব্যবহার করেন ফুটপাথবাসী এবং এনআরএস হাসপাতালে আসা লোকজনই। সেই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। প্রায় হাজারখানেক মহিলা রোজই এই সুলভটি ব্যবহার করেন। আর দিনে এই শৌচাগার পরিষ্কার হয় মাত্র চার বার!
অন্য দিকে, টালিগঞ্জ রেলব্রিজের নীচের সুলভে এক লাইনে পরপর পুরুষ এবং মহিলাদের শৌচাগার। মাঝখানে একটি কাঠের পাঠাতন দিয়ে আলাদা করা থাকলেও, নীচের অংশে মহিলাদের দিকটি পুরোপুরি আড়াল করা নেই। ভিতরে সাবানের কাগজ, শ্যাম্পুর খালি প্যাকেট চার দিকে ছড়ানো। নর্দমার মুখে যেমন নোংরা, তেমনই দুর্গন্ধ। বজবজ থেকে আসা গৃহবধূ অণিমা গুপ্তকে জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, টালিগঞ্জ স্টেশনে কোনও শৌচাগার না থাকায় এটিই ব্যবহার করতেই হয়। পর্যাপ্ত জল রয়েছে বটে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শৌচাগারটি পরিষ্কার নয় বলে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে।
শুধু এই সব সুলভই নয়। কলকাতার উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য কলকাতার অধিকাংশ সুলভেই ধরা পড়ল এই ছবি। সে ক্ষেত্রে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পুরসভা নির্মিত এই সুলভগুলি দেখভালের দায়িত্ব কার?
মূলত এই দায়িত্ব পুরসভাই। যে দায় এড়াচ্ছে কলকাতা পুরসভা। কী ভাবে? পুরসভার দাবি, তারা শুধু সুলভগুলি তৈরি করে দেয় এবং দরপত্র ডেকে সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের ভার দেয় বিভিন্ন বেসরকারি কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। চু্ক্তির মাধ্যমে শৌচাগারগুলি হস্তান্তর হয়।
শহরের অধিকাংশ সুলভ শৌচাগারগুলির দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। কিন্তু দেশজুড়ে যে সংস্থাটি সুলভ শৌচাগার তৈরিতে জড়িত, সেই সুলভ ইন্টারন্যাশনালের তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে থাকা কন্ট্রোলার বিজয় কুমার ঝা-র বক্তব্য, তাঁদের মূল ভাবনা হল অর্থের বিনিময়ে সাধারণ মানুষকে সুস্থ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিষেবা দেওয়া। তাই কলকাতায় তাঁদের হাতে যে কয়েকটি সুলভের দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলি পরিষ্কার রাখতে সারা দিনের জন্য সাফাইকর্মী রয়েছে। শৌচাগার নোংরা হলেই তাঁরা পরিষ্কার করেন। এর পাশাপাশি সব কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য সংস্থার আলাদা লোক রয়েছে। কিন্তু কলকাতা পুরসভা বর্তমানে যে সব সংস্থার হাতে দায়িত্ব দেয়, তারা এককালীন টাকা দিয়ে শৌচাগারগুলির দায়িত্ব নেয়। কিন্তু শৌচাগার পরিষ্কার হচ্ছে কি না, তার জন্য সংস্থাগুলি কতটা দায়িত্ব নেয় তা জানা নেই। বিজয়বাবুর মতে, এখনকার নতুন ছোট ছোট সংস্থাগুলি পরিষেবার থেকে বেশি ব্যবসার উপর জোর দেয়। তাই সুলভ শৌচাগার অপরিচ্ছন্নই থাকে। আর পুরসভাও রোজ সেগুলিতে নজরদারি করে না।
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে সুলভ শৌচাগারগুলি হস্তান্তর করা হলেও নিয়মানুযায়ী সেগুলি পরিষ্কার করা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব কলকাতা পুরসভার উপরেই বর্তায়। এর জন্য বছরখানেক আগে একটি টাস্কফোর্সও গড়া হয়েছিল। কিন্তু সেই টাস্কফোর্সও এখন কাজ করছে না বলে জানালেন পুরসভারই এক আধিকারিক। তিনি জানান, বছরখানেক আগে তৈরি টাস্কফোর্স রিপোর্টের ভিত্তিতেই শহরের ৩৪ নম্বর এবং ৯১ নম্বর ওয়ার্ডের দু’টি সুলভ শৌচালয়ের ভারপ্রাপ্ত দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বদলানো হয়। কারণ আগের সংস্থাগুলি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ঠিকমতো করতে পারছিল না।
বর্তমানে টাস্কফোর্স কাজ করছে না কেন? মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দার বলেন, “পর্যবেক্ষণ করার জন্য যে পরিকাঠামো দরকার, তা না থাকাতেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই মাসখানেক আগে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শৌচাগার পরিষ্কার থাকছে কি না, তা দেখার জন্য স্থায়ী টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হবে। আলোচনাও হয়েছে। পুরভোট এসে পড়ায় আপাতত এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা যাচ্ছে না।”
স্বপনবাবু জানান, এই মুহূর্তে শহরের সুলভ শৌচালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩৫০টি। এর মধ্যে দোতলা শৌচালয় ৬০টি। এই শৌচালয়গুলির মধ্যে ২৫০টি সচল রয়েছে। বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকার শহরে সংখ্যালঘু এলাকায় দ্বিতল শৌচালয় তৈরির জন্য প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। বাকি ৩ লক্ষ টাকা দেয় কলকাতা পুরসভা এবং রাজ্য সরকার। যদিও সাধারণ মানুষের দাবি, শহরের বিভিন্ন জায়গায় আরও শৌচাগারের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমানে যে ক’টি সুলভ রয়েছে, সেগুলিরই ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ এবং সাফাই হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে শৌচাগারের সংখ্যা আরও বাড়লে সেগুলির হালও তো এ রকমই হবে।
এই প্রশ্নেও একই উত্তর দিয়েছেন মেয়র পারিষদ। তিনি জানিয়েছেন, টাস্কফোসর্র্ তৈরি হলেই সব সমস্যা মিটবে। অনেক দিন আগেই সাধারণ মানুষের দাবি মতো আরও শৌচালয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কারণ শহরের বাইরে থেকে প্রচুর লোক আসেন যাঁরা এই সুলভগুলি ব্যবহার করেন। কিন্তু পুরভোট এসে যাওয়ায় এখন আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না।
সুলভ শৌচালয়গুলি অচল থাকার কারণ কী? পুর-কর্তৃপক্ষ জানান, কিছু শৌচালয়ের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দরপত্র দেওয়া নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। সঠিক দর না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে পুর-কর্তৃপক্ষ পিছিয়ে এসেছেন।
নিয়মানুযায়ী, এগুলি চালানোর জন্য বিজ্ঞাপন দেন। যে সংস্থা পুরসভাকে বেশি দর দেয়, সেই সংস্থাকেই পুরসভা চুক্তির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শৌচাগার হস্তান্তর করে। যদি সেই সংস্থা সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালাতে না পারে, তা হলে পুরসভা চুক্তি বাতিলও করতে পারে।
সমস্যা তৈরি হয়েছে শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় ‘সুলভ’ নির্মাণ ঘিরেও। পুরসভা সূত্রে খবর, বড়বাজার এলাকায় প্রায় ৩০টি ‘সুলভ’ শৌচালয় রয়েছে। আরও কয়েকটি নির্মাণের জন্য জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা রয়েছে বিবাদী বাগ এলাকাতেও। এখানে সুলভ নির্মাণের ব্যাপারে এখনও নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা নেই বলে পুর-কর্তৃপক্ষ জানান।