ফাইল চিত্র।
‘লড়াই করেই বাঁচতে চাই!’
২০০৭ সাল থেকে একজোট হয়ে লড়ার পরে এমন একটা দিন এসেছে! রাগের ঝোঁকে ফোনে-হোয়াট্অ্যাপে স্বামী তিন তালাক বলে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আর চলে যাবে না এ দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের স্ত্রীদের অধিকার। এর আনন্দ মুখে প্রকাশ করারও নয়। কিন্তু তাই বলে কি অবসান হল লড়াইয়ের? মোটেও নয়।
সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার পরে এমনটাই বলছেন এ শহরে নারীদের সমান অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তেরা। তাঁদের বক্তব্য, দেশের উচ্চতম আদালত এ বার আইনের অস্ত্র হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু এত দিনের লড়াইয়ের পরে তাঁরা এটা বুঝে গিয়েছেন যে, এখানেই শেষ নয়। বরং এ বার আরও লম্বা লড়াই। পার্থক্য হল, এখন এগিয়ে চলার পথটা অনেকটাই স্পষ্ট। এই রায়ের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া আইনই বলে দেবে, আগামী দিনে কোন দিকে গতি পাবে মুসলিম মহিলাদের আন্দোলন।
রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক খাদিজা বানোর যেমন বক্তব্য, সারা দেশ অন্তত এ বার জানল কত সাধারণ অধিকারের জন্যেও কত মানুষকে লড়তে হয়। তবে তাঁর স্পষ্ট কথা, এই আইনে থেমে থাকবে না তাঁদের কাজ। কারণ পার্সোনাল ল’ নয়, বাকি দেশের নাগরিকেরা যে আইনের আওতায় পড়েন, সেই আইনের অধিকার প্রয়োজন মুসলিম মহিলাদেরও।
খাদিজার ক্ষোভ, ‘‘যাঁদের জন্য এই লড়াই, তাঁদের এই সাফল্যের আনন্দ পেতে হলেও যে অনেকটা এগোতে হবে। লড়াইটা সেইখানেই।’’ তাঁর আক্ষেপ, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বেরোনোর পরে অনেক গ্রামে এই কথা জানাতে গিয়ে আবার কঠোর বাস্তবটা সামনে চলে আসছে। কত মহিলার যে সেই শিক্ষাটুকুও জোটেনি যে তিনি বুঝবেন, এই রায় গণতন্ত্রের পক্ষে। বহু গ্রামে মহিলারা যে জানেনই না এখনও, সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্য এই আইন তাঁদের অস্ত্র হতে পারে। এ কথা বোঝার জন্য যে তাঁদের শিক্ষার অধিকার প্রয়োজন।
তিনি মনে করান, এখনও ‘হালালা নিকাহ’ আইনসম্মত। পারিবারিক সম্পত্তিতেও মেয়েদের সমান অধিকার নেই। শ্বশুর বেঁচে থাকতে থাকতে যদি মৃত্যু হয় স্বামীর, তবে তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়িতে থাকার অধিকারও জোটে না মহিলাদের। সন্তান-সহ বার করে দেওয়া হয় তাঁদের।
একই সুর ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’-এর সক্রিয় কর্মী রহিমা খাতুনের। তিনি বলেন, ‘‘খুব আনন্দ হচ্ছে এই রায় পেয়ে। দশ বছর ধরে চলছে এই কাজ। তবে আমাদের কাজ থামবে না। এখনও লড়াইয়ের অনেকটাই বাকি।’’ বাকি নাগরিকদের মতো সমান অধিকার অর্জন করতে হলে যে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলকে আরও অনেক কাজ করতে হবে, তা এখনই বুঝছেন তিনি।
নারী আন্দোলনের আর এক কর্মী শাশ্বতী ঘোষ আবার মনে করান, ‘‘এই লড়াইয়ের পথ খুব কঠিন হওয়ারই কথা। এ তো একটা সম্প্রদায়ের জন্য সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই লড়াই। এটা অল্প দিনে শেষ হওয়ার নয়।’’ এমনকী, আইন পাশ হলেই সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে না সমাজের সব ধারণা। তবে তাঁর মত, এর পরে কোনও পুরুষ যদি কাজীর থেকে তালাকনামা সই করিয়েও নেন, তা হলে অন্তত দু’পক্ষই জানবে যে কাজটা বেআইনি!
তবে আগামী দিনে লড়াইয়ের পথ আরও যতটাই কঠিন হোক, একটি বিষয়ে তাঁরা সকলেই সহমত— এই রায় অবশেষ গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে ভারতীয় মুসলিম সমাজের মহিলাদের প্রতিবাদী ক্ষমতা। সমান অধিকারের জন্য এত দিন ধরে যাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কথাও যে শোনা দরকার, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।