Tangra Triple Murder Case

ট্যাংরার সেই হানাবাড়ির দরজায় ঋণের নোটিস, জমছে বিদ্যুৎবিল! তিনটি খুনের ১০ মাস পরে কী অবস্থায় দে পরিবারের প্রাসাদ?

গত ১২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ট্যাংরার ‘চিত্তনিবাস’কে আমূল বদলে দিয়েছে। একইসঙ্গে পরিবারের তিন সদস্যকে খুন করা হয়েছিল এই বাড়িতেই। এখন দরজায় তালা। সে তালায়ও জং ধরেছে। জানলার কালো কাচে জমছে ধুলো।

Advertisement

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৭
Share:

ট্যাংরার দুই ভাই (বাঁ দিকে) প্রণয় দে এবং প্রসূন দে (ডান দিকে)। (পিছনে উপর থেকে) প্রণয়ের স্ত্রী সুদেষ্ণা দে, প্রসূনের স্ত্রী রোমি দে এবং কন্যা প্রিয়ম্বদা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ট্যাংরার অতল শূর রোডের ‘চিত্তনিবাস’। সামনে ফুট পাঁচেকের রাস্তা। চারতলা বাড়িটিকে ছোটখাটো প্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। আদ্যোপান্ত সিসি ক্যামেরায় মোড়া এই বাড়ি মাস দশেক আগেও গমগম করত। একতলার গ্যারেজে গাড়ির আসা-যাওয়া, ছোটদের স্কুলে যাতায়াত তো ছিলই, পুজোআচ্চা, জন্মদিনের হইহুল্লোড়ও লেগে থাকত। এখন সে সব নেই। ফাঁকা বাড়ির জানালার কালো কাচে ধুলো জমেছে। দরজার ফাঁকে জমেছে বিদ্যুতের বিল আর ঋণের নোটিস। যাতায়াতের পথে এই বাড়ির দিকে পাড়ার লোকজন কেউ আর ফিরেও তাকান না।

Advertisement

‘চিত্তনিবাস’-এর দরজার ফাঁকে গোঁজা বিদ্যুতের বিল। —নিজস্ব চিত্র।

গত ১২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ট্যাংরার ‘চিত্তনিবাস’কে আমূল বদলে দিয়েছে। একসঙ্গে পরিবারের তিন সদস্যকে খুন করা হয়েছিল এই বাড়িতে। নিজের স্ত্রী, কন্যা এবং দাদার স্ত্রীকে খুন করে বাড়ির ছোট ছেলে প্রসূন বেরিয়েছিলেন দাদা প্রণয় ও দাদার পুত্র প্রতীপকে নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল আত্মহনন। কিন্তু পথে তাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে প়ড়ে। আপাতত দুই ভাই হাজতবাস করছেন। কিশোর প্রতীপ বড় হচ্ছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আর তাঁদের ‘প্রাসাদ’ হানাবাড়ির চেহারা নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

ট্যাংরার অতল শূর রোডের ‘চিত্তনিবাস’। —নিজস্ব চিত্র।

কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল, ‘চিত্তনিবাস’-এর তালায় জং ধরেছে। পালিশ করা কাঠের দরজায় সাঁটা রয়েছে দু’টি কাগজ। ঋণখেলাপির নোটিস সেঁটে দিয়ে গিয়েছেন কেউ। সেই দরজারই ফাঁকে গোঁজা কয়েকটি বিদ্যুতের বিল। পাশের বাড়ির এক জন বললেন, ‘‘কিছু দিন আগে ইলেক্ট্রিকের লোক এসেছিল। মনে হয় লাইন কেটে দিয়েছে।’’

Advertisement

হত্যাকাণ্ডের পর ট্যাংরার অতল শূর রোড দিয়ে জীবনের স্রোত বয়ে যাচ্ছে আগের মতোই। কেবল ‘চিত্তনিবাস’ থমকে আছে। প্রাসাদের চাবি আপাতত পুলিশের কাছে। বিতর্কিত দে পরিবারকে নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি নন। প্রতিবেশীরা জানালেন, ঘটনার পর প্রথম প্রথম পুলিশ আসত, সাংবাদিকেরাও ভিড় করতেন। এখন আর কেউ আসেন না। গ্রেফতারির পর অভিযুক্তদের এক বার ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল বটে। তবে এ নিয়ে পাড়ায় আর তেমন উৎসাহ বা কৌতূহল নেই। ঝাড়পোঁছ করতেও আসেন না কেউ? প্রশ্ন শুনে উল্টো দিকের বাড়ি থেকে এক মহিলা বললেন, ‘‘কে আসবে? ভিতরে যে যাবে, তারই তো ভয় লাগবে।’’ তিন জনের অপঘাতে মৃত্যু! সেই বাড়ির পাশাপাশি বাড়িতে থাকতে ভয় করে না? প্রতিবেশীদের কথায়, ‘‘ওরা তো তেমন কারও সঙ্গে কথা বলত না। আমাদের ভয় করে না। তবে বাইরে থেকে কেউ এলে ভয় পেতেই পারেন।’’

‘চিত্তনিবাস’-এর সামনে বাইক এবং সাইকেল দাঁড় করানো হয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।

গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে ছিলেন প্রণয়-প্রসূনেরা। ব্যাঙ্ক-সহ একাধিক সংস্থার কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন। বাড়ি, গুদাম বন্ধক পর্যন্ত রেখেছিলেন। সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ পৌঁছে গিয়েছিল সাত থেকে আট কোটি টাকায়। দাবি, ব্যবসায় মন্দা এবং ঋণ পরিশোধ করতে না-পারার হতাশা থেকেই তাঁরা সপরিবার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চেষ্টা করেও নিজে থেকে মরতে পারেননি পরিবারের দুই বধূ সুদেষ্ণা দে ও রোমি দে। তাই তাঁদের খুন করেন প্রসূন। মেরে ফেলা হয় কিশোরী প্রিয়ম্বদাকেও। বাবা ও কাকার বিরুদ্ধে পরে বয়ান দিয়েছে ১৫ বছরের প্রতীপ। জানিয়েছে, কাকা কী ভাবে তার মুখে বালিশ চেপে ধরেছিলেন। কোনও রকমে শ্বাস বন্ধ করে রেখে মরে যাওয়ার ভান করে সে যাত্রায় সে প্রাণে বেঁচেছে।

দে বাড়ির দরজায় সাঁটা ঋণখেলাপির নোটিস। —নিজস্ব চিত্র।

যে সংস্থা দে বাড়িতে ঋণখেলাপির নোটিস সেঁটেছে, তাদের মূল দফতর মুম্বইয়ে। কলকাতার দফতরের কেউ ট্যাংরার ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে নোটিস অনুযায়ী, ওই সংস্থা থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩৫ লক্ষ ২৯ হাজার ৯৭৫ টাকা ধার নেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে ঋণ শোধ করছিলেন প্রণয়রা। শেষ বার সংস্থায় টাকা দেওয়া হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। অগস্ট পর্যন্ত সুদ-সহ বকেয়ার পরিমাণ ৩৭ লক্ষ টাকার বেশি। যদি তা পরিশোধ না-করা হয়, তবে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে ওই নোটিসে।

ঘটনার পর দীর্ঘ দিন কলকাতার হোমে ছিল এই বাড়ির একমাত্র জীবিত নাবালক সদস্য প্রতীপ। প্রথম প্রথম কেউ খোঁজ নিতে আসতেন না। পরে কাকিমা রোমির বাবা-মা তাঁকে হোম থেকে নিয়ে যান। আপাতত তাঁদের কাছেই থাকছে কিশোর। নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে। শুরু হয়েছে তার নতুন জীবনযুদ্ধ। ট্যাংরার বাড়িতে ফেরার মতো অবস্থা অবশ্য নেই তার। বাবা জেলে, মা নেই। অতীত কি ভুলতে পেরেছে প্রণয়ের পুত্র? সে কি জানে, তাদের সাজানো-গোছানো ঝাঁ চকচকে ‘চিত্তনিবাস’ এখন পাড়ার হানাবাড়ি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement