গেরুয়া রঙা এমন মিষ্টিই ফের আসছে বাজারে। নিজস্ব চিত্র
‘রং দে তু মোহে গেরুয়া...’
এ হেন আর্তিই ফিরে ফিরে আসছে! লোকসভা ভোটের ফলের হাত ধরে দু’দশক আগের সেই দিনগুলোও ফিরে আসছে বলাই যায়! নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় বার শপথ গ্রহণের দিনে ঠিক যেন দু’দশক আগের ‘অ্যাকশন রিপ্লে’।
তখন নিয়মিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে এই মিষ্টি পাঠাতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দিদি’র আবদার রক্ষাতেই গেরুয়া রঙা সন্দেশ-রসগোল্লা তৈরির কায়দাও রপ্ত করে ফেলেছিল বাংলার ময়রাকুল। রিষড়ার ফেলু ময়রার উত্তরপুরুষ অমিতাভ মোদক বলছিলেন, ‘‘এই গেরুয়া রং আনাটা জাফরানের মাত্রার উপরে নির্ভর করছে।’’ মিষ্টি-কারবারিদের ‘ভেনঘরের’ খবর, এক কেজি ছানায় সাধারণত দু’গ্রাম জাফরানের ছোঁয়াচ জরুরি। দক্ষ কারিগরেরা জানেন, কোশাকুশিতে জাফরান থেঁতো করে একটু জল মেশালেই রং তৈরি। সেই রংই ছানায় ছড়িয়ে দিতে হবে। তবে রসগোল্লায় আগে জাফরান যোগ করা হয়! সন্দেশের পাক শেষ হলে মিষ্টির দোকানের ‘পাটা’ বা বড় পিঁড়িতে ফেলে ‘ফিনিশিং টাচ’ দেওয়ার পর্বেই জাফরান প্রয়োগ।
একদা শ্রীরামপুরের প্রয়াত সাংসদ আকবর আলি খোন্দকরের হাত ধরেই কালীঘাট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল রিষড়ার মিষ্টি। ’৯৮ ও ’৯৯ সালে বাজপেয়ীজি দু’বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়েই ‘মাঙ্গলিক’ শাঁখ সন্দেশ পাঠিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। সেই শাঁখে অবশ্য গেরুয়া-সাদা-সবুজ তিনটি রংই ছিল। সঙ্গে খোদাই করা পদ্ম ও জোড়া ফুল— তৃণমূল-বিজেপি, দু’দলের প্রতীক।
আপাতত অবশ্য রাজ্যে ফুলে-ফুলে তুমুল টক্করের আবহে সেই সহাবস্থানের প্রশ্ন ওঠে না। রাজ্যে তৃণমূলের জয়ের ধারাবাহিকতার সূত্রে ইদানীং ভোটের পরে সবুজ রঙা রসগোল্লা তৈরিই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাতে সবুজ ফুড কালারের সঙ্গে আমাদাবাটাও যোগ হত, কাঁচা আমের স্বাদ আনতে। চাহিদার অভাবে গেরুয়া সন্দেশ-রসগোল্লা তখন কার্যত হারিয়েই যাচ্ছিল। আবার সে আসিছে ফিরিয়া!
তবে অভিজ্ঞ ময়রারা অনেকেই জাফরানের সঙ্গে এলাচ গুঁড়োটুড়ো প্রয়োগ করেন না। তাতে জাফরানের গন্ধটা মার খাবে। বদলে কাজ করছে জায়ফল-জয়িত্রী। এর আগে কলকাতায় লালকৃষ্ণ আডবাণী বা সুষমা স্বরাজেরা এলেও গেরুয়া রঙা উচ্চাঙ্গের সন্দেশ দেখা যেত। মিষ্টি-স্রষ্টাদের একাংশের ধারণা, এটা শুধু প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের বিষয় নয়, অন্য দল থেকে বিজেপিতে যাত্রার ধারা অক্ষুণ্ণ থাকলে এমন গেরুয়া মিষ্টির চাহিদাও জারি থাকবে।
মোদীর শপথের দিনে বড়বাজারে তিওয়ারির লাড্ডুর জয়জয়কার। কিন্তু লাড্ডুকে এখনও স্ব-জাতীয় বলে ধরতে আপত্তি আছে আমবাঙালির। তা ছাড়া, মিষ্টিতে বিজেপি-র মহিমা আর বাংলা-সংস্কৃতি— দু’টোই মেলে ধরতে হলেও লাড্ডু ব্রাত্যই। দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্তান সুইটস এই পরিবর্তিত বাজারে তাদের গাজরের রসগোল্লাকে তুলে ধরছে। দোকানের কর্ণধার রবীন্দ্রকুমার পাল বলেন, ‘‘গাজরের রসগোল্লার চাহিদা ভোটের পরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। গাজর অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট। তা ক্যানসার মোকাবিলার অস্ত্র।’’
বাংলার পরম্পরায় মিষ্টির সঙ্গে রাজনীতির যোগ আগেও দেখা গিয়েছে। রানি ভিক্টোরিয়ার অভিষেক উপলক্ষে ‘করোনেশন সন্দেশ’, কংগ্রেস সভাপতি হয়ে মতিলাল নেহরুর বাংলায় আসা উপলক্ষে ‘নেহরু সন্দেশ’ তৈরি হয়েছিল। দেশের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁরা তেরঙা ‘জয়হিন্দ’ সন্দেশ চালু করেছিলেন বলে দাবি করে সেন মহাশয়। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ আগে বাম ঐক্যের বার্তা দিতে বাম দলগুলির প্রতীকের মিষ্টি পাঠাতেন। ঠিক গেরুয়া না হলেও বিজেপি-র সাফল্যের সূত্রে কমলাভোগও খুব দেখা যাচ্ছে। আগে সাধারণত দার্জিলিং কমলালেবুর খোসা দিয়ে কমলাভোগ হলেও এ যুগে হলুদ ফুড কালার আর কমলালেবুর বিদেশি এসেন্সই ভরসা।
২০১৪-য় লোকসভা ভোটের আবহেও ভবানীপুরে বলরাম মল্লিকের দোকানে মোদী-ছাপ সন্দেশের রমরমা দেখা গিয়েছিল। ভোটের আগে মোদী, রাহুল গাঁধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মানে আলাদা গোত্রের সন্দেশও তারা তৈরি করে। কিন্তু পরে কোনওটাই বাজারে টেকেনি। বলরাম মল্লিকের কর্ণধার সুদীপ মল্লিক বলছেন, ‘‘যখন যে যা বলছে, তা-ই করে দিচ্ছি!’’
রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের নানা রকম ‘উন্মাদনা’ দেখা গেলেও মিষ্টিতে রাজনীতির রং লাগা নিয়ে কিছুটা সাবধানী মিষ্টি-স্রষ্টারা।