‘আমাদের যা গিয়েছে, তা কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’

জিএসটি চালুর পরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন কেউ। নোটবন্দির জেরে কাউকে আবার জেলেও যেতে হয়েছে। এটিএম-এর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কারও আবার বেঘোরে প্রাণ গিয়েছিল। ভোটের মুখে কেমন আছে তাঁদের পরিবার? জিএসটি চালুর পরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন কেউ। নোটবন্দির জেরে কাউকে আবার জেলেও যেতে হয়েছে। এটিএম-এর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কারও আবার বেঘোরে প্রাণ গিয়েছিল।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯ ০০:৫১
Share:

স্মৃতি: বাবার ছবি হাতে শুভদীপ। বৃহস্পতিবার, বেহালায়। নিজস্ব চিত্র

ছাদের সিঁড়ির মুখে দেওয়ালে দশ ইঞ্চির সিমেন্টের গাঁথনি। বছর এগারোর শুভদীপের কাছে সেটাই ‘পড়ার তাক’। বইপত্রের সঙ্গে তিন নম্বর তাকে থরে থরে সাজানো রং-পেনসিল, তুলি। রয়েছে কালো ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবিও। ছবিটি দেখিয়ে শুভদীপ বলে, ‘‘এটাই আমার বাবা। বাবা চাইত আমি আঁকা শিখি। শনিবার করে বাড়ি ফিরত। রবিবার সকালে আমাকে আঁকার স্কুলে নিয়ে যেত। বাবা মারা যাওয়ার পরে আর আঁকতে যাই না।’’

Advertisement

পরিণত শোনায় কিশোরের গলা। খানিকটা যেন অভিমানীও।

শুভদীপের পরিবারে অবশ্য জমে আছে শুধুই রাগ। বছর দু’য়েক আগের কথা উঠলে সে পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘‘মানুষ মারার খেলা শুরু হয়েছিল। এটিএমের লাইনের সামনে রাস্তায় পড়ে একটা লোক ৪০ মিনিট ধরে ছটফট করল। অথচ, কেউ লাইন ছেড়ে লোকটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন না! সকলেই লাইন চলে যাওয়ার ভয় পেলেন? এক রাতের ঘোষণায় গোটা দেশকে সব ছেড়ে এটিএমের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন ওঁরা।’’ শুভদীপের মা সীমা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘রাজনীতিতে না গিয়েই একটা প্রশ্ন করছি— আমাদের যা গিয়েছে, তা কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’’

Advertisement

২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। তত দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের পুরনো ৫০০ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিলের ঘোষণার পরে মাস ঘুরতে চলেছে। নতুন নোট পেতে এটিএম বুথে বুথে লাইন। কোচবিহার থেকে বেহালার আদর্শনগরের বাড়িতে ফিরছিলেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মী কল্লোল রায়চৌধুরী। বন্ধুদের সঙ্গে হুগলির ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে ট্রেন বদলে কলকাতায় ফেরার কথা ছিল তাঁর। বন্ধুদের ট্রেনে তুলে দিয়ে স্থানীয় একটি এটিএমের সামনে লাইন দেন তিনি। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান কল্লোলবাবু। তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে শুরু করলে চুঁচুড়া ইমামবড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। অভিযোগ ওঠে, দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ কল্লোলবাবুকে সাহায্য করতে আসেননি। কল্লোলবাবুর বৌদি বলেন, ‘‘সামনের মাসেই ছেলের স্কুলে ভর্তির টাকা দেওয়ার কথা ছিল। এত দিন পরে বাড়ি ফিরছে কিছু টাকাও সঙ্গে আনার কথা ছিল। সেই টাকা তোলার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গিয়েছেন আমার দেওর।’’

এই মৃত্যু নিয়ে সেই সময়ে রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতায় স্বামীর চাকরি পান কল্লোলবাবুর স্ত্রী সীমাদেবী। এখন বেহালাতেই ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অফিসে কর্মরত তিনি। চাকরির পাশাপাশি ছেলের পড়াশোনা এবং সংসার সামলান তিনি।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে দক্ষিণ কলকাতার রাজনীতিতে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে এই মৃত্যু নিয়ে। দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মালা রায় বলছেন, ‘‘স্বামীর অবর্তমানে ওই মহিলার লড়াইকে কুর্নিশ। নোট বাতিলের মতো এমন জনবিরোধী সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেয়নি। ২৩ মে ওই মিথ্যাচারের জবাব পাবে বিজেপি।’’ তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত, চলতি লোকসভা নির্বাচনে দক্ষিণ

কলকাতার বিজেপি প্রার্থী চন্দ্র বসু অবশ্য বলছেন, ‘‘নোট বাতিল করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশকে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। যে যা-ই বলুন, মানুষ মোদীর সঙ্গে আছে। অর্থনীতিবিদ হিসেবে বলছি, আরও বেশ কয়েক বার নোট বাতিল হওয়া প্রয়োজন।’’

ওই কেন্দ্রের বাম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের যদিও বক্তব্য, ‘‘বিজেপি-র সরকার যে গরিবের সরকার নয়, তা সকলের কাছেই স্পষ্ট। তৃণমূলও ওই পথের পথিক। মানুষ বুঝেছে, আদতে কারা গরিবের কথা বলে। নোট বাতিলের ভুল ঢাকতে ওঁরা এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করছেন।’’ সেই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘নোট বাতিলে কার সুবিধা হয়েছে? কত কালো টাকা ফিরল তা-ই যাঁরা গুনতে পারেন না, তাঁরা দাবি করছেন, রাতের অন্ধকারে জঙ্গি ঘাঁটির লাশ গুনে ফেলেছেন!’’ (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement