দরজায় কড়া নেড়ে ছেলের দল বলে না, ‘চাঁদা চাই’

জুলুম তো দুরস্থান এই পুজোর কোনও চাঁদাই নেই। এখানেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম উত্তর কলকাতার নীলমণি দত্ত লেন। শহর ও শহরতলির সর্বত্রই দুর্গাপুজো মানে মোটা অঙ্কের চাঁদা। সেই চাঁদা তোলা নিয়ে অনেক সময়ই জুলুমেরও অভিযোগ ওঠাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু নীলমণি দত্ত লেনের পুজোয় সে সবের বালাই নেই। গলির কুড়ি থেকে বাইশটি বাড়ির বাসিন্দারা নিজেরাই এই পুজোর খরচ দেন। কারও ভাগে পড়ে ঢাকির খরচ, কেউ দেন ঠাকুরের ভোগের টাকা, কেউ পুরুত মশাইয়ের দক্ষিণা।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৩৭
Share:

জুলুম তো দুরস্থান এই পুজোর কোনও চাঁদাই নেই। এখানেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম উত্তর কলকাতার নীলমণি দত্ত লেন।

Advertisement

শহর ও শহরতলির সর্বত্রই দুর্গাপুজো মানে মোটা অঙ্কের চাঁদা। সেই চাঁদা তোলা নিয়ে অনেক সময়ই জুলুমেরও অভিযোগ ওঠাও নতুন কিছু নয়। কিন্তু নীলমণি দত্ত লেনের পুজোয় সে সবের বালাই নেই। গলির কুড়ি থেকে বাইশটি বাড়ির বাসিন্দারা নিজেরাই এই পুজোর খরচ দেন। কারও ভাগে পড়ে ঢাকির খরচ, কেউ দেন ঠাকুরের ভোগের টাকা, কেউ পুরুত মশাইয়ের দক্ষিণা। পাড়ার মহিলারা আবার মাটির ভাঁড়ে প্রতিদিন পাঁচ দশ টাকা করে জমিয়ে তুলে ফেলেন পুজোর খরচ। আড়ম্বরহীন এই পুজোয় মণ্ডপ তৈরির খরচও আবার ভাগ করে কয়েক জন মিলে দেন। আর যাঁদের এই সব খরচ দেওয়ারও সার্মথ্য নেই তাঁরা সারা বছরে একটু একটু করে দুর্গাপুজোর জন্য জমানো পয়সার ভাঁড় ভেঙে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে দেন। এই ভাবেই গত আট বছর ধরে চাঁদা ছাড়াই হচ্ছে নীলমণি দত্ত লেন সর্ব্বজনীন দুর্গোৎসব। পুজো কমিটির তরফ থেকে জানানো হল, তাঁদের কোনও পুজো বাজেট নেই। নীলমণি দত্ত লেনের ২০ থেকে ২২টি বাড়ির বাসিন্দারা পুজোর জন্য যা দেন তা দিয়েই হয়ে যায় সর্বজনীন পুজো।

নীলমণি দত্ত লেনের সরু গলির ভেতর বাঁশ বাঁধা হয়ে গিয়েছে। পুজো কমিটির সদস্যরা জানালেন সোমবার বিকেল থেকেই মণ্ডপে ত্রিপল টানানোর কাজ শুরু হবে। পুজো কমিটির এক সদস্য কিরণ লাহা বলেন, “কোনও বাড়তি আড়ম্বর নেই আমাদের পুজোয়। তবে এই লেনের সব বাড়ির সদস্যদের এই পুজোর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। তাই ন’বছর ধরে নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজো হচ্ছে। টাকা পয়সা নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না।”

Advertisement

এই পুজো থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কলেজ স্কোয়্যার, লেবুতলার মতো বড় মাপের পুজো হয়। এ ছাড়াও আশপাশে বেশ কয়েকটি মাঝারি মানের পুজোও হয় কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট এলাকায়।

তবু কেন এই লেনের ১৫০ জনের মতো বাসিন্দাকে আলাদা করে পুজো করতে হচ্ছে? পুজো কমিটির সদস্যরা জানালেন তাঁরা পুজো শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন কলেজ স্কোয়্যার ও লেবুতলার পুজোর জন্যই। দর্শনার্থীরা কলেজ স্কোয়ারের পুজো দেখে লেবুতলার পুজো দেখতে যাওয়ার জন্য এই লেনের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতেন। আশপাশে শৌচাগার না থাকায় বহু দর্শনার্থীরা রাত্রিবেলা তাঁদের গলিতে প্রস্রাব করে চলে যেতেন। এ ছাড়াও গলির রাস্তায় খাবারের প্যাকেট থেকে শুরু করে নানা নোংরা ফেলে চলে যেতেন। সেগুলো পরিষ্কার করাই দায় হয়ে উঠত। এই পুজোর এক সদস্য অসিত দত্ত বলেন, “পুজোর সময় রাত জেগে কে গলি পাহাড়া দেবে? গলি নোংরা হওয়ার হাত থেকে কী ভাবে মুক্তি পাওয়া যায় এই ভাবনা থেকেই বাসিন্দারা ঠিক করলেন গলিতে একটা পুজো করলে কেমন হয়? তা হলে দর্শনার্থীরা অন্তত প্রস্রাব করে নোংরা করতে পারবেন না।”

যেমন ভাবা তেমন কাজ। অসিতবাবুরা জানালেন, তাঁদের গলির মধ্যে যে সব বাড়ি রয়েছে তার বেশির ভাগ বাসিন্দাই অন্যত্র চলে গিয়েছেন। তাই বেশি চাঁদাও উঠবে না। তাঁদের গলিতে সেরকম লোকবলও নেই যে সদস্যরা গিয়ে বাইরে থেকে চাঁদা তুলবেন। কিন্তু দুর্গাপুজার তো

অনেক খরচ। কে চাঁদা তুলবে? কিরণ রাহা বলেন, “তখন ঠিক করা হয় চাঁদা না তুলেই পুজো হবে। জাঁকজমক করার দরকার নেই। নিষ্ঠা সহকারে পুজো হবে। পাড়ার সবাই অংশগ্রহণ করবেন।”

পুজোর সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে গলির মহিলারা এগিয়ে আসেন। পাড়ার বাসিন্দা রিনা দত্ত জানালেন, মূলত মেয়েদের উদ্যোগেই পুজো শুরু হয়। তিনি যেমন কুমারী পুজোর দায়িত্ব নেন, আবার রিনা দত্ত নামে অন্য এক বাসিন্দা দশকর্মা, প্রতিমার কাপড় ও অষ্টমীর ফুলের দায়িত্ব নেন। কেউ আবার বড় মাটির ভাড়ে প্রতি দিন পুজোর জন্য পাঁচ টাকা করে ফেলতে শুরু করেন। গলির এক বাসিন্দা বলেন, “মাটির ভাড়ে সারা বছর ধরে পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে কিন্তু খারাপ টাকা ওঠে না। আমিও পুজোর ঠাকুর আনার খরচ দিয়ে দিতে পারি।”

নীলমণি দত্ত লেনের সর্বজনীন পুজো কমিটির সদস্যরা জানালেন, এ বার তাদের প্রতিমা আসছে কুমোরটুলি থেকে। কোনও থিম নেই। একচালা প্রতিমা। আরও জানালেন, পুজোর ক’টা দিন তাঁদের নীলমণি দত্ত লেনেই কেটে যায়। ২৮ তারিখ পুজোর উদ্বোধন। কোনও বিশেষ অতিথি আসবেন না। লেনেরই কোনও বাসিন্দা উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনে গরিবদের কিছু জামাকাপড়ও দেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন