তাগিদ: রাতের শহরে এ ভাবেই জমে ওঠে ওঁদের বিকিকিনি। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
রাত আটটা চল্লিশ নাগাদ ট্রেনে ওঠেন জনা দশেক মহিলা। রাতে পৌঁছন শিয়ালদহে। মধ্য রাতে উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে আসবে ফল। সেই ফলের আশায় স্টেশন চত্বরেই কাটে সারা রাত। কিছু ক্ষণ সুখ-দুঃখ আদানপ্রদানের পরেই লেগে আসে চোখ। কেউ জাগেন, কেউ ঘুমোন। সকলে ঘুমিয়ে পড়া যায় না— বলছিলেন প্রবীণা মুসকান। তরুণী শবনম জানালেন, সকলে ঘুমোলেই জিনিসপত্র খোয়া যায়। এক দিন তাঁদের কাছ ঘেঁষে বসেছিল অচেনা এক যুবকও। সেই থেকেই ভাগ করে নেওয়া হয়েছে ঘুমের ডিউটি।
রাত তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ আসতে শুরু করে ফলের গাড়ি। ঝুড়ি ভর্তি ফল নিয়ে সকালের প্রথম ট্রেনে উঠে পড়েন শবনম-মুসকান-রুকসানারা। ডায়মন্ড হারবার বাজারে ফল বেচা-কেনা সেরে, তবে বাড়ি। ততক্ষণে হয়তো স্কুলে চলে গিয়েছে কারও সন্তান, কারও বা মত্ত স্বামী ঘুম থেকেই ওঠেননি।
শুধু ওঁরা নন, এ শহরের পথে কাজের তাগিদে রোজ রাত কাটে আরও বহু মহিলার। একা। সঙ্গে থাকেন না কোনও আত্মীয়।
ভয় করে না ওঁদের? এ শহরে ভয় আছে। কিন্তু আছে তা জয় করে এগিয়ে চলার সাহসও। বছরের পর বছর সেই রাতপথের ভরসাতেই বাড়ছে সেই মহিলাদের সংসার, লেখাপড়া শিখছে সন্তানেরা।
‘‘ভয় করলে কি চলবে? বিপদে পড়লে সকলে ঠিক পাশে দাঁড়ান। অনেক মেয়েকেই সারা রাত কাজ করতে হয়’’— বলছিলেন ময়না। শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে খদ্দেরের জন্য কাগজের কাপে চা ঢালতে ঢালতে গল্প জুড়লেন নিজেই। তাঁর ঠেলা গাড়িতে আছে বিস্কুট-কেক-ডিম-পাঁউরুটিও। কেউ এসে পোচ-অমলেট চাইলেই জ্বালিয়ে ফেলেন ছোট্ট স্টোভ। বাসন্তী হাইওয়ের কাছের বাড়ি থেকে প্রায় রাতেই সংসারের কাজ সেরে একা বেরিয়ে পড়েন ময়না। বাস-অটো-ট্রেন। তার পরে স্টেশন থেকে কিছুটা দূরের এক ‘দিদির’ বাড়ি থেকে ঠেলাটা নিয়ে আসা। রাত এগারোটায় শুরু হওয়া ব্যবসা চলে রাতভর। বেশি ক্ষণ অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে, এগিয়ে আসেন তাঁর পথের বন্ধুরাও। রাস্তা পেরিয়ে এসে ময়না বৌদির খোঁজ নেন এক ট্যাক্সিচালক। ময়না বলেন, ‘‘আমরা এ ভাবেই একে-অপরের খেয়াল রাখি।’’
বেলেঘাটায় বাইপাসের কাছেই বসতি এলাকায় রুটি-আলুরদম বিক্রি করেন বছর পঁতাল্লিশের বিবিদি। গত বারো বছর ধরে এই কাজ করছেন। রোজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত দু’টো। একা হাতে সবটা। বাড়িতে কেউ নেই সাহায্য করার? একটাই ছেলে। কলেজে পড়েন। মা চান ছেলে পড়াশোনাটাই ভাল ভাবে করুন। এত রাত পর্যন্ত একেবারে একা? বেরিয়ে আসতে থাকে বারো বছর আগের কত কথা। রোজগার না থাকা, স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়া। কোনও আত্মীয়কে ছাড়া সারা রাত কাজ করতে সমস্যা হয়নি? ‘‘কত লোকে কত খারাপ কথা বলেছে,’’ বলেন বিবিদি।
কসবার লক্ষ্মী অবশ্য সে সব নিন্দা-মন্দের পরোয়া করতে নারাজ। দুই সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব আছে তাঁর। স্বামীর বিশেষ রোজগার নেই। দিনের বেলা কয়েকটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ সেরে রাত বারোটা থেকে বাড়ির সামনেই দোকান চালান তিনি। চা-পাঁউরুটি-কেকের জন্য অনেকেই মাঝরাতে গাড়ি থামান সেখানে। ভোর পর্যন্ত চলে দোকান। সেই পাড়ার এক বাসিন্দা জানান, মধ্যরাতে মত্ত বাইকচালকেরা এসে দোকানে হইচই করলে অনেক সময়েই আপত্তি জানান পড়শিরা। তবে তিনি দমে যাননি। বরং এই দোকানকে ভরসা করেই আরও ভাল ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন।
রাতের শহরে কাজে ব্যস্ত এই মহিলাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখে কি পুলিশ? লালবাজারের একাধিক কর্তা জানান, রাতে টহলদারি ভ্যান সর্বত্র নজর রাখে। কেউ নিয়ম মেনে দোকানদারি করছেন কি না, তা অন্য বিষয়। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে আপস হয় না। যাঁরা দীর্ঘদিন কোনও এলাকায় ব্যবসা করছেন, তাঁদের সম্পর্কে তথ্য পুলিশের কাছে থাকে।