বাংলার সোনার মেয়েই দেশছাড়াদের ‘পারের দূত’ 

মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে যাওয়া বনি এখন আর ফুটবল গোলে পাঠান না। তবে বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ ভাবে ভারতে ঢুকে পড়া ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ফিরে যায় বনির হাত ধরেই।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯ ০১:৪৪
Share:

ভরসা: ভারতে হারিয়ে যাওয়া এক বাংলাদেশি কিশোরকে ফিরিয়ে দিতে পেট্রাপোল সীমান্তে বন্দনা পাল (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। নিজস্ব চিত্র

মেয়েদের জাতীয় ফুটবলে বাংলা শেষ বার যাঁর সোনালি গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই বন্দনা পাল ওরফে বনি এখন বিভিন্ন দেশের ‘হারিয়ে যাওয়া’ ছেলে-মেয়ের ‘পারের দূত’।

Advertisement

মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে যাওয়া বনি এখন আর ফুটবল গোলে পাঠান না। তবে বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ ভাবে ভারতে ঢুকে পড়া ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ফিরে যায় বনির হাত ধরেই। রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর, রূপান্তরকামী ফুটবলার বনিকে নিয়োগ করেছে তাদের দু’টি হোমে। যেখানে দেশের এক সময়ের নামী এই ফুটবলার ভারতে ঢুকে পড়া ছেলে-মেয়েদের সংশোধন করেন, বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেন, ফুটবল শেখান, সঙ্গে শেখান হাতের কাজও। আটত্রিশ বছরের বনির কথায়, ‘‘সতেরো-আঠেরো মাস পরে সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেলে ওদের সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে আসি।’’ উত্তর ২৪ পরগনায় গোবরডাঙ্গার বনি হিসেব দেন, গত আড়াই বছরে কিশলয় ও সুকন্যা, এই দু’টি সরকারি হোম থেকে অন্তত ২৪ জন ছেলে-মেয়ে তাঁর হাত ধরে ফিরে গিয়েছে নিজেদের দেশে।

ঢাকার একটি গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছিল বছর পনেরোর দিলু খোন্দকর (নাম পরিবর্তিত)। ভাল কাজ দেওয়ার নামে আড়কাঠিরা সীমান্ত পেরিয়ে তাকে আনা হয় এই দেশে। পাসপোর্ট ছিল না। বসিরহাটের একটি চায়ের দোকানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় দিলু। ঠাঁই হয় সরকারি হোমে। সেখানে ফুটবল খেলার পাশাপাশি পড়াশোনা করত সে। দেড় বছর পরে নানা নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে যখন তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন বনি, তখন তার কান্নায় ভারী হয়ে গিয়েছিল বেনাপোল সীমান্ত এলাকা।

Advertisement

প্রতিমা মণ্ডলের বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। বছর পনেরোর মেয়েটিকে নারী পাচারকারীরা নিয়ে এসেছিল। ঘুটিয়ারি শরিফের একটি যৌনপল্লি থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। নিয়ে আসা হয় একটি সরকারি হোমে। সেখানে বনির কাছে ফুটবল শিখত সে। দূতাবাসের মাধ্যমে তার বাড়ি খুঁজে যখন প্রতিমাকে তুলে দেওয়া হয় বি ডি আরের হাতে।

নীলম থাপা নেপালের মেয়ে। কাঠমান্ডুর এক বস্তি থেকে পাড়ার এক যুবক সতেরো বছরের মেয়েটিকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল বারাসতের এক ব্যবসায়ী পরিবারে। সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম তো ছিলই, সঙ্গে চলত নির্যাতন। এক পড়শির সাহায্যে পুলিশে যায় মেয়েটি। এর পরেই হোমে ঠাঁই হয় তার। দেড় বছর পরে তার বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দূতাবাস। এর পরে তাকে সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হয় নেপাল সেনাদের হাতে।

দিলু, প্রতিমা, নীলমের মতো অসংখ্য ছেলে-মেয়ে প্রতি বছর দারিদ্রের তাড়নায়, কাজের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে দালালদের হাত ধরে আসে এ দেশে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ঠাঁই হয় হোমে। হোমে আসার পরে বনি, ওরফে বন্দনার কাজ শুরু হয়। ‘‘ওদের সঙ্গে গল্প করে বোঝার চেষ্টা করি, কী ভাবছে। বাড়ির ঠিকানা জানার চেষ্টা করি,’’ বলছিলেন বনি।

মেয়ে থেকে ছেলে হওয়ার পরে বিয়ে করে সংসার করছেন তিনি। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাকে চ্যাম্পিয়ন করলেও, নয়ের দশকের এই ফুটবলারের শরীরী গঠনে পুরুষত্ব প্রকাশ পাওয়ায় তাঁকে আর খেলতে দেওয়া হয়নি। ফলে চাকরি জোটেনি বন্দনা ওরফে বনির। দার্জিলিঙের হোটেলে রান্নার কাজ করতেন এক সময়ে। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় পরিবারেও দেখা দেয় নানা সমস্যা। শিলিগুড়িতে শুরু করেন প্রতিমা তৈরির কাজ। কিন্তু অভিযোগ, বহু পুজো কমিটি নিয়মিত টাকা দিত না। ফলে দারিদ্রের তাড়নায় সে কাজও ছাড়তে হয় তাঁকে। তার পরেই ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করে নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর। তাঁর কাজে সহযোগিতা করেন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার মণিশঙ্কর দে।। সকলের উপরে আছেন সুপারিটেন্ডেন্ট মলয় চট্টোপাধ্যায়।

ফুটবলার থেকে সীমান্ত ‘পারের দূত’ হিসেবে নতুন ভূমিকার বন্দনাকে নিয়ে একটি বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরি করছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সরকারি আইনি সহায়তা কেন্দ্র (ডালসা)। সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনি সচেতনতা বাড়াতেই তৈরি হচ্ছে এই তথ্যচিত্র। অভিযোগ, বন্দনা নিজে তেমন আইনি সহায়তা পাননি। তাঁর মনে পড়ে, যখন মেয়েদের ফুটবল থেকে কার্যত জোর করে ‘ছেলে’ বলে তাড়িয়ে দেওয়া হল, তখন সে ভাবে কেউ দাঁড়াননি পাশে। তাই এই তথ্যচিত্র নিয়ে বেশ উত্তেজিত এক সময়ের ‘সোনার মেয়ে’। তিনি বলেন, ‘‘এই ছবি দেখে যদি আমার মতো অসহায়েরা সাহায্যের রাস্তা খুঁজে পান, তবে খুব খুশি হব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন