যানজট ঠেলে মহোৎসবের মাতন

মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকেই মহানগরের বিভিন্ন রাস্তায় আটকে যাচ্ছিল যানবাহন। বেলা ১২টার পরে তা ভয়াবহ আকার নেয়। দক্ষিণ কলকাতায় যানজট বাড়িয়ে দেয় এক পশলা হঠাৎ-বৃষ্টি।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৫৮
Share:

আজ মহাষ্টমী<br> শান্তিরূপিণী। মঙ্গলবার বেহালা দেবদারু ফটকে অরুণ লোধের তোলা ছবি।

সকাল জানিয়ে দেয়, কেমন যাবে দিন। সকালই জানান দিল, সপ্তমীতে যথেষ্ট ভোগান্তি আছে কপালে।

Advertisement

মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকেই মহানগরের বিভিন্ন রাস্তায় আটকে যাচ্ছিল যানবাহন। বেলা ১২টার পরে তা ভয়াবহ আকার নেয়। দক্ষিণ কলকাতায় যানজট বাড়িয়ে দেয় এক পশলা হঠাৎ-বৃষ্টি। তার উপরে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটি ধর্মীয় মিছিল। বেলা ২টোয় যাদবপুর থেকে গড়িয়াহাট— আটকে গেল বাস, গাড়ি, ট্যাক্সি। ১০ মিনিটের পথ যেতে সময় লাগল এক ঘণ্টারও বেশি।

একই অবস্থা দেশপ্রাণ শাসমল রোডের। টালিগঞ্জ থেকে উত্তরমুখী গাড়ি ঘুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, লেক গার্ডেন্স, সাদার্ন অ্যাভিনিউ দিয়ে। এক সময় ওই রাস্তাগুলিও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গাড়ির চাপে। ওই সব রাস্তায় বড় বড় পুজো। সকাল থেকেই কাতারে কাতারে দর্শক। সব মিলিয়ে হিমশিম অবস্থা। দীর্ঘ ক্ষণ বিভিন্ন রাস্তায় আটকে থাকা মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে, রাস্তায় যথেষ্ট পুলিশ ছিল না। লালবাজার তা অস্বীকারও করেনি। তবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই পুলিশের সংখ্যা বাড়ে সব রাস্তায়। পরিস্থিতির উন্নতি হয় ধীরে ধীরে।

Advertisement

দক্ষিণে দুপুরের এক পশলা বৃষ্টি পুজোর আনন্দটাকে প্রায় মাটি করে দিচ্ছিল। গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়ানো এক ট্রাফিক-কর্তা বারবার হাওয়া অফিসে ফোন করে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি জানতে চাইছিলেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বৃষ্টিটা তাড়াতাড়ি না-ধরলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’’ আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানায়, স্থানীয় ভাবে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়েই এই বৃষ্টি। পরিমণ্ডলে কোনও ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপরেখা নেই। তাই পুজোর বাকি তিন দিন মেঘাসুরের দাপাদাপি কমই থাকবে।


সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নান। গঙ্গার ঘাটে মঙ্গলবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

বৃষ্টি থেমে যায় কিছু পরেই। সন্ধ্যার আগেই জমে থাকা মেঘ উধাও। হইহই করে রাস্তায় নেমে পড়ে জনতা। ভিড়ের চাপে বাইপাস থেকে ভিআইপি রোড, বরাহনগর থেকে বালিগঞ্জ প্রায় অবরুদ্ধ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এম বাইপাসের রাসবিহারী কানেক্টরে দাঁড়ানো পুলিশকর্তার ওয়্যারলেসে ঘনঘন বার্তা আসছে, ‘‘গড়িয়াহাট মোড় আর আশপাশের এলাকায় ভিড় উপচে পড়ছে। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করুন।’’ বেহালার ডায়মন্ড হারবার রোডে পাশাপাশি চলেছে যানবাহন আর জনস্রোত! দমদম জংশন স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে জনস্রোত ঢুকে পড়ছে মেট্রোয়। লোকাল ট্রেনের বাকি ভিড়টা রওনা দিচ্ছে শিয়ালদহ-উল্টোডাঙার দিকে।

এ বার তৃতীয়া থেকেই শহরের পথে নেমে পড়েছেন দর্শকেরা। তৃতীয়া থেকে পঞ্চমী, ভিড়ের গন্তব্য ছিল দেশপ্রিয় পার্ক। পুজোর শহরে শুরু হয়েছিল নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা। পরিস্থিতি সামলাতে শেষ পর্যন্ত দেশপ্রিয় পার্কের পুজো দর্শকদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। বোধনের সন্ধ্যা থেকেই তাই ভিড়টা ছড়িয়ে পড়ছে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে বন্দর এলাকায়।

প্রতি বছরই পুজোয় দল বেঁধে লোকজন এক-একটি এলাকায় ভিড় করেন। ভিড়ের সেই ধরনটাকে মাথায় রেখে এ বার জোট বেঁধে সার্কিট তৈরি করেছেন পুজো-উদ্যোক্তারা। অনেকটা সিকিম কিংবা দার্জিলিং-কালিম্পঙের মতো! সার্কিট গড়ে ভিড় ধরে রাখছে খিদিরপুরের ২৫ পল্লি, পল্লি শারদীয়ার মতো পুজোগুলি। ভবানীপুর এলাকায় ঢুকলেই ভিড়টা চক্রবেড়িয়া সর্বজনীন থেকে অবসর, পদ্মপুকুর বারোয়ারি হয়ে রূপচাঁদ মুখার্জি লেন, সঙ্ঘশ্রীতে ঘোরাফেরা করে। এ বার ওই ক্লাবগুলি জোট বেঁধে শহরের ভিড়ের একটা বড় অংশকে নিজেদের দিকে টেনে রেখেছে। অবসরের পুজো-কর্তা শ্যামল দাসনাগ বলছেন, ‘‘আমরা এ বার ভিড়ের নিরিখে শহরের অনেক পুজোকেই টেক্কা দিয়েছি।’’ রূপচাঁদের হাতপাখার কাজ লোকজনের মনে ধরেছে। প্রবীণেরা সঙ্ঘশ্রীর মণ্ডপে ঢুকে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন। সেখানে মণ্ডপের ভিতরটা সাজানো হয়েছে পুরনো রঙ্গমঞ্চের কায়দায়!

রাত ৮টা। নাকতলা উদয়নে লোক ঢুকছে দলে দলে। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন, ‘‘শুনছি নাকি বিরাট বড় সূর্যমুখী ফুল করেছে।’’ তা শুনে পাশ থেকে পত্রপাঠ এক তরুণের টিপ্পনী, ‘‘বড় নিয়ে বড়াই করবেন না। দেখলেন তো, বড়র কী হাল হল!’’ ইঙ্গিতটা দেশপ্রিয় পার্কের ‘সব চেয়ে বড় দুর্গা’র দুর্গতির দিকেই।

দক্ষিণ কলকাতার ভিড় প্রতি বারেই সুরুচি সঙ্ঘ, চেতলা অগ্রণীর দিকে ছোটে। এ বছর লোকজন ওই সব পুজো দেখে তড়িঘড়ি পাড়ি দিচ্ছেন বেহালার দিকে। সেখানে অবশ্য বড়-ছোটর বালাই নেই। বাজেটের
বহর যেমনই হোক, ভিড় টানার লড়াইয়ে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে বেহালা-ঠাকুরপুকুরের পুজো। রাতে বেহালা থানার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি। তাঁর হাত ধরে থাকা বছর দশেকের ছেলেটা সমানে বলে চলেছে, ‘‘বাবা, নেপাল যাব।’’ বড়িশা নাবালিয়াপাড়া ইউনাইটেড ক্লাব এ বার মণ্ডপে তুলে এনেছে নেপালের ভূমিকম্পকে। মণ্ডপের চার পাশে বসে গিয়েছে সত্যিকারের নেপালি গ্রাম! হরিদেবপুরের অজেয় সংহতির ছৌনাচ, ৪১ পল্লির ভাসমান শিল্প কিংবা আদর্শ সমিতির মুন্ডা গ্রাম দেখে একটা ভিড় ঢুকে পড়ছে বেহালায়। ঠাকুরপুকুরের এসবি পার্ক সর্বজনীনের সামনে সন্ধ্যা ৭টাতেই লম্বা লাইন। নামী ক্লাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে ঠাকুরপুকুর ক্লাবের তাঁতের শাড়ির কাজও। মণ্ডপ থেকে বেরোনোর মুখে এক মহিলা তাঁর সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘পুজোর পরে ওই শাড়িগুলি কী করবে গো?’’

রাত ৯টা। টালা বারোয়ারির বিজ্ঞান-ভিত্তিক থিম দেখে ভিড়টা সটান রওনা দিল বাগবাজারের দিকে। ভিড়ের মধ্যে এক তরুণী বললেন, ‘‘যতই থিম নিয়ে মাতামাতি হোক, বাগবাজার বা সিমলার সাবেকিয়ানার জৌলুসই আলাদা।’’ কলকাতার প্রথম সর্বজনীন পুজো শ্যামপুকুর সর্বজনীন কয়েক বছর থিম করার পরে এ বার ফের সাবেকি ধাঁচে পুজো করছে। আবার বহু বছর সাবেকিয়ানাকে আঁকড়ে থাকার পরে থিমের হাত ধরে ভিড় টানছে পার্ক সার্কাস ময়দানের পুজো। সেখানে অবশ্য পুজোর সঙ্গে উপরি পাওনা মেলা।

রাত ১২টা। কসবা বোসপুকুরের পুজো দেখে ভিড় ঢুকছে গড়িয়াহাট চত্বরে। এ দিকে একডালিয়া, হিন্দুস্থান পার্ক থেকেও বেরিয়ে আসছে ভিড়। সেই ভিড়টা রওনা দিচ্ছে সেলিমপুর, যোধপুর পার্কের দিকে। ইএম বাইপাস থেকে সন্তোষপুরে ঢোকা ভিড়টার অনেকটাই টেনে নিচ্ছে সন্তোষপুর লেকপল্লি। ঢল সামলাতে দলবল নিয়ে নাজেহাল লেকপল্লির পুজো-কর্তা সোমনাথ দাস, রানা দাশগুপ্ত।

একই অবস্থা উত্তরে হাতিবাগান এলাকার। উল্টোডাঙা থেকে তেলেঙ্গাবাগান, করবাগান দেখে খন্না সিনেমা হয়ে ভিড়টা ঢুকছে। ও-দিক থেকে হাতিবাগানের দিকে ভিড়টাকে ঠেলে দিচ্ছে আহিরীটোলা-কুমোরটুলি। কুমোরটুলি পার্কেও এ বার নেপালের ভূকম্প তুলে ধরা হয়েছে। ভিড় সামলাতে নেমেছে হ্যাম রেডিও অপারেটরের ২৭ জনের একটি দল। যারা নেপালের বিপর্যয়েও কাজ করেছে। সেই দলের নেতা অম্বরীষ নাগবিশ্বাস বললেন, “দুপুর থেকেই লাগামছাড়া ভিড়। সন্ধ্যার পর থেকে সামলানোই দায়।” ফুটপাথে ভিড় আর রাস্তার গাড়ি— সামলাতে নাকাল পুলিশও।

এর মধ্যে কলকাতার উপকণ্ঠে ভিআইপি রোড ও যশোর রোডে নতুন সমস্যা তৈরি করছে মোটরবাইক বাহিনী। রাত ৩টে। সময় দেখাচ্ছে ভিআইপি-র ‘বিগ-বেন’। এক দিকে জনস্রোত চলেছে ঠাকুর দেখতে। অন্য দিকে বাইক নিয়ে রাস্তায় ঝড় তুলেছে কিছু যুবক। কয়েকটি বাইকে ঝলমলে পোশাক পরা তরুণীরাও রয়েছেন। বেশির ভাগ বাইকেই তিন জন, চালক বা সওয়ারি কারও মাথাতেই হেলমেট নেই। ঝড়ের গতিতে বাইক চালানোর পাশাপাশি পথচলতি মানুষকে কটূক্তি, গালাগাল দিচ্ছে, উন্মত্তের মতো আচরণ করছে কেউ কেউ। সব দেখেও না-দেখার ভান করছে বিধাননগরের পুলিশ। লেক টাউন মোড়ের কাছে কয়েক জন বাইকচালক পুলিশের কাছে গিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘‘এই তো আস্তে করে দিয়েছি... রাগ করে না।’’ তার পরেই ফের ঝড়ের গতিতে কেষ্টপুর উড়ালপুলের দিকে রওনা দিল বাইক।

আজ, বুধবার মহাষ্টমী। পুলিশের হিসেবে ভিড় সামলানোর সব থেকে কঠিন দিন। লালবাজারের কর্তারা বলছেন, সপ্তমীর রাত থেকেই ভিড়ের রাশ হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁরা। অষ্টমীর রাতে শহরে যানবাহনের গতি আরও মসৃণ হবে। ভিড় হলেও অসুবিধা হবে না।

সত্যিই সেটা হয় কি না, দেখা যাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন