দুষ্কৃতী খুনে ধরা পড়ল স্ত্রী এবং প্রেমিক

দফায় দফায় জেরা ও মোবাইলের সূত্রকে কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরে গত ৭ অক্টোবর নেহাকে গ্রেফতার করে খড়দহ থানার পুলিশ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭ ০১:১৭
Share:

নেহা বিবি

জমজমাট শপিং মলের সামনে পরপর পাঁচটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল এক যুবক। সপ্তমীর বিকেলে কামারহাটির সেই ঘটনার তদন্তে নেমে শেষ পর্যন্ত পুলিশের জালে ধরা পড়ল গোটা ঘটনার মূল দুই চক্রান্তকারী। তারা ওই যুবকেরই স্ত্রী ও তার প্রেমিক।

Advertisement

পুলিশ সূত্রের খবর, গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্ত্রী নেহা বিবিকে নিয়ে কামারহাটির ওই শপিং মলে কেনাকাটা করে বাইরে বেরোয় ইছাপুরের বাসিন্দা মহম্মদ কুদ্দুস ওরফে নান্নে। পুলিশের খাতায় দীর্ঘ দিন ধরেই ওই যুবক কুখ্যাত দুষ্কৃতী বলে পরিচিত। ঘটনার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন, পুরনো কোনও শত্রুতার জেরেই কুদ্দুসকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই তার স্ত্রী নেহার গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল তদন্তকারীদের। সেই মতো ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা ও খড়দহ থানার ওসি মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি দল তদন্ত শুরু করে।

দফায় দফায় জেরা ও মোবাইলের সূত্রকে কাজে লাগিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরে গত ৭ অক্টোবর নেহাকে গ্রেফতার করে খড়দহ থানার পুলিশ। এর পরে ওই দিনই ধানবাদ থেকে ঝাড়খণ্ড পুলিশের কনস্টেবল জওহরলাল মাহাতো ওরফে রাজীবকে ধরে ব্যারাকপুর পুলিশ। পুলিশের দাবি, দু’জনেই জেরায় স্বীকার করেছে যে, ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে খুন করা হয়েছে কুদ্দুসকে। তাকে গুলি করা হয় অটোমেটিক রিভলভার থেকে।

Advertisement

পুলিশ সূত্রের খবর, কুখ্যাত দুষ্কৃতী কুদ্দুসকে বছর ছয়েক ধরে বিভিন্ন জেলার পুলিশ খুঁজছিল। পুলিশের তাড়া খেয়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিল ওই যুবক। বছর দু’য়েক আগে নেহাকে নিয়ে সে চলে যায় আসানসোলের নিয়ামতপুরের কাছে লছিপুরে। সেখানেই ঘর ভাড়া করে দু’জন থাকতে শুরু করে। জেরায় নেহা পুলিশের কাছে দাবি করেছে, সেখানে গিয়ে তাকে জোর করেই যৌন ব্যবসায় নামায় কুদ্দুস। লছিপুরে গিয়ে নেহার নাম বদলে হয় সীমা। সেই সময়ে ওই যৌনপল্লিতেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় পুলিশকর্মী জওহরলালের। সে নেহাকে বলেছিল, তার নাম রাজীব। ক্রমশ দু’জনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়।

নেহা জেরায় জানিয়েছে, জওহরলাল কখনওই চাইত না সে যৌন ব্যবসায় থাকুক। তাই ওই যৌনপল্লি থেকে নেহাকে বার করে আনার জন্য প্রচুর টাকাও খরচ করতে শুরু করে ওই পুলিশকর্মী। এ সব নিয়ে কুদ্দুস ও নেহার মধ্যে অশান্তিও তৈরি হয়। সাত-আট মাস আগে জওহরলালের সঙ্গে আলাদা করে সংসার পাতারও পরিকল্পনা করে ফেলে এক সন্তানের মা নেহা।

পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে ইছাপুর এলাকায় নিজেদের বাড়ি তৈরি করতে শুরু করে নেহা এবং জওহরলাল। মাঝেমধ্যে আসানসোল থেকে সেখানে এসে থাকত নেহা। সঙ্গে কুদ্দুসও। তবে পুলিশের তাড়া খেয়ে কুদ্দুস গা-ঢাকা দিলে মাঝেমধ্যে সেখানে আসত জওহরলাল। নেহা দাবি করেছে, কুদ্দুস চাইত না সে যৌন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু জওহরলাল তাকে নতুন ভাবে সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

এর পরেই পথের কাঁটা কুদ্দুসকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে নেহা ও তার প্রেমিক। জেরায় তারা জানায়, এক সময় পুলিশের বিশেষ অপারেশন গ্রুপে থাকার সুবাদে জওহরলালের সঙ্গে ধানবাদের অনেক ভাড়াটে খুনির পরিচয় ছিল। তাদেরই এক জনকে মোটা টাকার বিনিময়ে কাজে লাগানো হয়। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, ব্যারাকপুর স্টেশনে একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে কুদ্দুসকে মারা হবে।
কিন্তু পঞ্চমীর দিন ধানবাদ থেকে টিটাগড়ে এসে ঘাঁটি গাড়া ভাড়াটে খুনি তাতে রাজি হয়নি। এর পরেই বেছে নেওয়া হয় কামারহাটির ওই শপিং মলকে।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই নেহার বয়ান এবং আচরণে প্রচুর অসঙ্গতি ছিল। শপিং মল থেকে বেরিয়ে কেন সে একা একা একটু আড়ালে ফুচকা খেতে চলে গিয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তাকে। আবার প্রত্যক্ষদর্শীরা খুনির চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছিল, তার সঙ্গে মিলছিল না নেহার বর্ণনা। তা ছাড়া, কারও স্বামী খুন হলে স্ত্রীর মধ্যে যে ধরনের শোক-বিহ্বলতা দেখা যায়, নেহার আচরণে তা একেবারেই ছিল না। আবার নিজের মোবাইল নম্বরও বারবার করে ভুল দিচ্ছিল সে।
সব মিলিয়ে সন্দেহ হওয়ায় নেহাকে ডেকে জেরা শুরু করেন তদন্তকারীরা। দেখা যায়, ঘটনার কয়েক দিন আগে এবং পরে বিশেষ কয়েকটি ফোন নম্বরে বহু বার কথা বলেছে নেহা। জানা যায়, সব ক’টি নম্বরই ধানবাদের এক যুবকের। এমনকী নেহা বারবার থানাতে জেরার জন্য আসা ও বেরনোর পরেও ওই নম্বর গুলিতে কথা হত।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, খুনের আগে এবং পরে বারবার নেহার সঙ্গে কথা হয়েছিল জওহরলালের। কে, কী রঙের জামা পরে রয়েছে, কী করছে, সবই জওহরলাল জানতে পারছিল ঝাড়খণ্ডে বসেই। ৭ অক্টোবর ওই তরুণীকে জেরা করতেই জানা যায়, ওই যুবক পুলিশে কাজ করে। কিন্তু রাজীব হিসেবে নাম ভাঁড়ানোয় তাকে চিহ্নিত করতে বেগ পেতে
হয় পুলিশকে। যদিও পরে ধানবাদে থাকা ব্যারাকপুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় জওহরলাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন