জরুরি নিজেকে ভালবাসার পাঠ

কিন্তু মনোবিদ, সমাজবিদেরা মনে করছেন, এরই পাশাপাশি নজর এড়িয়ে যাচ্ছে অন্য একটি দিক। তা হল মেয়েদের নিজেকে ভালবাসতে না শেখার প্রবণতা।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৭ ০০:৫৯
Share:

কখনও হত্যা। কখনও আত্মহত্যা। আবার কখনও তিল তিল করে নিজেকে, শরীরকে অবহেলা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। এক অর্থে সেও আত্মহত্যারই সামিল। মেয়েদের বিবাহ-পরবর্তী জীবনের এমন নানা ঘটনায় গত কয়েক দিন ধরে তোলপাড় হচ্ছে রাজ্য। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। কেন মেয়েকে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ না দিয়ে সব মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাবা-মা, সমালোচিত হচ্ছে তাও। কিন্তু মনোবিদ, সমাজবিদেরা মনে করছেন, এরই পাশাপাশি নজর এড়িয়ে যাচ্ছে অন্য একটি দিক। তা হল মেয়েদের নিজেকে ভালবাসতে না শেখার প্রবণতা। অনেকেই মনে করছেন, অন্যকে ভালবাসার পাশাপাশি নিজেকে ভালবাসাও কতটা জরুরি, তা মেয়েদের আশৈশব শেখানো হয় না বলেই বহু মেয়ের জীবন এ ভাবে করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: আলোয় সাজবে রেড রোড

দিন কয়েক আগে দমদমের সুভাষনগরের শ্রাবন্তী মিত্রের মৃত্যুর পরে মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘‘কেন তাড়াহুড়ো করল মেয়েটি? কেন আর একটু ধৈর্য্য ধরল না? মাত্র তো কয়েক মাস হল বিয়ে হয়েছিল!’’ শ্রাবন্তীর ঘটনার পরে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হয়েছে দ্রুত। শনিবার নীলাঞ্জনা বলেন, ‘‘আমি জীবনটাকে যে ভাবে চেয়েছি সে ভাবে না পেলে কেন সরে যাব, কেন নিজেই নিজের মতো করে সবটা গড়ার চেষ্টা করব না, এটা অনেক মেয়েই ভাবে না। আসলে পরনির্ভরশীল হয়ে বাঁচার মানসিকতা থেকেই এটা হয়। মেয়েদের পড়াশোনায় ভাল হতে শেখানো হয়, কিন্তু নিজের জীবনের চাওয়াগুলোকে নিজের মতো করে অর্জন করাটা শেখানো হয় না। গলদটা সেখানেই।’’

Advertisement

মনোবিদেরা বলছেন, যে সব ক্ষেত্রে খুনের অভিযোগ উঠছে, সেখানে তদন্ত ও পরবর্তী স্তরের বিচারপর্ব চলতে থাকে। কিন্তু যেখানে মেয়েরা নিজেদের শেষ করে দেয়, সেখানে বহু ক্ষেত্রেই নিজেকে ভাল না বাসার কারণটা মুখ্য। পাশাপাশি বাস্তববোধের অভাবটাও থাকে প্রকট। মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদারের কথায়, ‘‘এখন মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা হচ্ছে। কিন্তু বিয়ের পরে অন্য পরিবারে গিয়ে থাকার যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার, তা তৈরি করা হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা দরকার। কারণ বিয়েকে ঘিরে স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ, দুটোই থাকে সমান্তরাল ভাবে। একটা স্বপ্ন ভাঙলে যে জীবনটা শেষ হয়ে যায় না, বাবা-মায়েরা তা মেয়েদের শেখান না। আর তাই বিয়ের পরে কোনও স্বপ্ন না মিললেই ‘আমার জীবনটার আর কোনও অর্থ নেই’—এই বোধ মেয়েটিকে ক্রমশ খাদের কিনারায় ঠেলে দেয়।’’

প্রশ্ন উঠেছে, স্কুল স্তরে যৌন শিক্ষা, কম বয়সে বিয়ের ক্ষতিকর দিক, এমনকী হাল আমলে অনলাইনে নানা ধরনের বিপজ্জনক খেলা বন্ধ করার ব্যাপারেও নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কেন ছোট থেকে মেয়েদের চেতনায় এটাও ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে না যে, নিজেকে ভাল রাখা যে কোনও মানুষের প্রাথমিক দায়িত্ব। নিজেকে ভাল না রাখলে অপরকে ভাল রাখা যায় না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শরণ্যা চৌধুরী বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনুপ্রিয়া ভৌমিকের মতে, ছোট থেকে একটি মেয়েকে শেখানো হয়, ‘অন্যকে ভাল রাখার মধ্যেই তোমার সার্থকতা’। তাই বিয়ের পরে সে যখন দেখে অসুখী সম্পর্কের জেরে পরিজনেরা কষ্ট পাচ্ছেন, তখন নিজেকে শেষ করে ফেলাটাই বেশি গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে মনে হয়। অনুপ্রিয়ার কথায়, ‘‘ভাল চাকরি করা অনেক মেয়েকে দেখেছি, নিজের জন্য কিছু কিনতে কুণ্ঠিত বোধ করছেন। জিনিসটা তাঁর খুব পছন্দ। কিন্তু কিনলে অন্যেরা কী ভাববেন, সেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। মনে মনে এও ভাবেন যে, নিজেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়াটা আসলে স্বার্থপরতা।’’

নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী শাশ্বতী ঘোষ বলছিলেন, ‘‘সেল্‌ফ প্যাম্পারিং’-এর কথা বাদই দেওয়া হল। আমি এমন কিছু হেলাফেলা নই যে নিজেকে শেষ করে দেব, এই উপলব্ধিটাই বহু মেয়ের তৈরি হয় না। নিজেকে মুছে দিয়ে যে কোনও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না, তা বোঝার জন্য যে মানসিকতা প্রয়োজন, সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা হয় ক’টা পরিবারে?’’ শাশ্বতীর মতে, ‘‘ছেলেমেয়েকে মানুষ করার এই দায়িত্ব শুরু হয় বাড়িতে। তার পরে স্কুলে। ক্লাসে কোনও ছেলেকে টপকে পড়াশোনায় বা খেলাধুলোয় কোনও মেয়ে এগিয়ে গেলে ছেলেটির মা-বাবা বহু সময়েই বলেন, ‘কী রে একটা মেয়ের কাছে হেরে গেলি?’ মেয়েকে আলাদা ভাবে এক জন মানুষ হিসেবে না ভাবতে শেখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয় বাড়িতেই। ঠিক সে ভাবেই ছেলেদের পুরুষ হয়ে উঠতে শেখায়ও এই পরিবারই।’’

বহু ক্ষেত্রেই স্বামী সরাসরি অত্যাচার না করলেও স্ত্রীর উপরে হওয়া অত্যাচার হজম করে নেন। স্বামীর ক্ষেত্রে এই অভিমানটা যেমন একলা করে দিয়েছিল শ্রাবন্তীকে। অভিমান কাটিয়ে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে গড়ে তোলায় আত্মবিশ্বাসী হতে পারেননি তিনি। তাঁর মতো পরিণতির আগে বাকি মেয়েরা কবে সেই আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরছে অনেকের কাছেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন