চলছে সেই মঞ্চ খোলার কাজ। শনিবার, রেড রোডে। — নিজস্ব চিত্র
একটি দুর্ঘটনা। মৃত্যু। মন্ত্রীদের ছুটে যাওয়া এবং রুটিন মাফিক ক্ষতিপূরণ ঘোষণা— সবই হল। তারই সঙ্গে সামনে এল কয়েকটি প্রশ্ন। যার সঙ্গে জড়িত ন্যূনতম সুরক্ষা ও তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা।
শুক্রবার রেড রোডে যেখানে নতুন সরকারের শপথ নেওয়ার মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, শনিবার সকালে সেই মঞ্চ খুলতে গিয়েই অন্তত ৪০ ফুট উঁচু বাঁশের কাঠামো থেকে পড়ে যান গৌতম নস্কর (৪৫) নামে এক শ্রমিক। রক্তাক্ত ও গুরুতর জখম অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষার কথা যে খেয়াল রাখা হয় না, গৌতমবাবুর মৃত্যুই তার প্রমাণ। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অঘটন ঘটে যাওয়ার পরে হয় চৈতন্য। এ বারও তেমনই ঘটেছে। এক জন শ্রমিকের মৃত্যুর পরে সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা খেয়াল হয় প্রশাসনের। এ দিন সকালে যাঁরা মঞ্চ খোলার কাজ করছিলেন, তাঁদের কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। বিকেলে অবশ্য দেখা গেল, সব শ্রমিকের মাথায় হেলমেট। টাটকা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার জের।
তবে শ্রমিকদের একাংশের ক্ষোভ, রাজ্যের নতুন সরকারের শপথগ্রহণের মঞ্চ খোলার সময়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে এত হইচই। দেরিতে হলেও করা হয় সুরক্ষার ব্যবস্থা। দুর্ঘটনাটি অন্য কোথাও ঘটলে এটুকুও হয়তো হত না। এটাই যে দস্তুর, জানালেন কয়েক জন শ্রমিক। গৌতমবাবুর সঙ্গেই বাঁশ খোলার কাজে নিযুক্ত অরবিন্দ সাউ নামে এক শ্রমিকের কথায়, ‘‘আমাদের বহু ছেলে এ ভাবে পড়ে মারা যায়। আমিও এক বার পড়ে গিয়েছিলাম। কপাল ভাল ছিল, তাই কোনও মতে বেঁচে যাই।’’ আরও কয়েক জন শ্রমিকের বক্তব্য, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানের জন্য বড় বড় মণ্ডপে বাঁশের কাঠামো তৈরি বা খোলার কাজে নিযুক্ত শ্রমিকেরা ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়াই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করেন। অনেক সময়ে দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে হইচই হয় না। নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে দুর্ঘটনা ঘটাতেই এত তোলপাড় হচ্ছে।
পূর্ত দফতরের কর্তারা বলছেন, এ ধরনের কাজে হেলমেট এবং সেফটি বেল্ট পরে কাজ করা উচিত। কিন্তু বেসরকারি তো দূর অস্ত্, সরকারি অনুষ্ঠানেও সে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় না। ‘‘যা তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে হয়, তাতে মণ্ডপ ঠিক মতো তৈরি হয়েছে কি না, সেটাই দেখা হয়। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বরাত পাওয়া ডেকরেটর মালিকদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়,’’ বলছেন পূর্ত দফতরের এক আধিকারিক।
রেড রোডের মঞ্চ তৈরির দায়িত্বে থাকা ডেকরেটর সংস্থার মালিক মন্টু সাহাও মেনে নিচ্ছেন, এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে হেলমেট, সেফটি বেল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তা হলে রেড রোডের ক্ষেত্রে তা ছিল না কেন? মন্টুবাবু জানান, এই শ্রমিকেরা কেউই তাঁদের স্থায়ী কর্মচারী নন। ঠিকাদার বা সর্দারের মাধ্যমেই বিভিন্ন জায়গায় ঠিকে কাজে নিযুক্ত হন। সর্দার হেলমেট, সেফটি বেল্ট চাইলে নিশ্চয়ই দেওয়া হয়।
বিভিন্ন ডেকরেটর সংস্থার মালিকদের আবার পাল্টা দাবি, শ্রমিকদের একাংশ নিজেরাই অনেক সময়ে হেলমেট বা সেফটি বেল্ট পরতে চান না। সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়ে কাজ করাটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছে। ডেকরেটরদের অনেকে এটাও বলছেন, কাজ শেষ করার যা তাড়া থাকে, নিরাপত্তা নিয়ে এত ভাবার অবকাশ থাকে না। ছোটখাটো ডেকরেটর ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সরঞ্জাম কেনাটাও অনেক ক্ষেত্রে বাহুল্য হয়ে পড়ে।
দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে চোখ খুলেছে মন্টুবাবুরও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি ৪৮ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। কোনও দিন এমনটা হয়নি। এ বার থেকে নিরাপত্তার উপরে জোর দিতেই হবে।’’
শপথগ্রহণ মঞ্চ খুলতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ায় সুরক্ষার বিষয়ে অবশেষে চিন্তিত সরকারও। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানান, এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ভাববে সরকার।
এ দিন দুর্ঘটনার খবর পেয়েই রেড রোডে হাজির হন রাজ্যের দুই মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিম। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, মৃতের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং পরিবারের এক জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।
গৌতমবাবুর ভাই উত্তম নস্কর হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘দাদা এ ভাবে চলে যাবে, তা ভাবতেও পারছি না। তবে সরকার পাশে থাকলে বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারব।’’
ডেকরেটর সংস্থার কর্ণধার মন্টুবাবু জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত ভাবে ওই শ্রমিকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন তিনি। গৌতমবাবুর কিশোর ছেলের পড়াশোনার ভার নেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।