আবাসিকদের পরিচয়পত্র নেই কলকাতার অধিকাংশ মেসে

তিনতলার ছাদের ছোট্ট ঘরে তিনটে ফোল্ডিং খাট পাতা। দু’টো ফোল্ডিং খাট জুড়ে একটি ডবল বেড করা হয়েছে। আর একটা ফোল্ডিং খাট পাশে পাতা। সেখানেই জায়গা দেওয়ার কথা মেস মালিকের। মেস মালিক আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পরিচয়পত্র সঙ্গে আছে তো? আছে জেনে বললেন, “যে দিন টাকা নিয়ে আসবেন সে দিনই পরিচয়পত্রের একটা জেরক্স দেবেন। পরিচয়পত্র ছাড়া আবাসিকদের থাকতে দিয়ে যা কাণ্ড ঘটল, এর পরে আর ঝুঁকি নিতে পারছি না।”

Advertisement

আর্যভট্ট খান ও গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৫৩
Share:

তিনতলার ছাদের ছোট্ট ঘরে তিনটে ফোল্ডিং খাট পাতা। দু’টো ফোল্ডিং খাট জুড়ে একটি ডবল বেড করা হয়েছে। আর একটা ফোল্ডিং খাট পাশে পাতা। সেখানেই জায়গা দেওয়ার কথা মেস মালিকের। মেস মালিক আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পরিচয়পত্র সঙ্গে আছে তো?

Advertisement

আছে জেনে বললেন, “যে দিন টাকা নিয়ে আসবেন সে দিনই পরিচয়পত্রের একটা জেরক্স দেবেন। পরিচয়পত্র ছাড়া আবাসিকদের থাকতে দিয়ে যা কাণ্ড ঘটল, এর পরে আর ঝুঁকি নিতে পারছি না।”

ওই মেস মালিকের কাছে জানা গেল, এতদিন পরিচয়পত্র দেখানোর কোনও বালাই ছিল না। দিন কয়েক আগে পরিচয়পত্র ছাড়া এক যুবক ওই মেসের অন্য দুই আবাসিকের দামি মোবাইল নিয়ে চম্পট দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে সেই যুবকের মোবাইল ফোন বন্ধ। তার কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও কোনও সমাধান হয়নি। দমদমের ওই মেসমালিক অন্য আবাসিকদেরও জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার থেকে পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে আবাসিকদের।

Advertisement

দমদমের ওই মেস মালিক ‘ঠেকে’ শিখেছেন। কিন্তু যাঁরা এখনও তেমন সমস্যায় পড়েননি, তাঁদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অবশ্য সেই সচেতনতা দেখা গেল না। বেলঘরিয়ায় অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ছোট্ট তিনটে ঘরের যে মেস, সেখানে চাকরিজীবীরাও থাকেন। এ রকমই এক আবাসিক বলেন, “মেসমালিককে পাবেন না। তিনি মেসে কম আসেন। আমি মেস চালাই। আমিই ম্যানেজার। যা বলার আমায় বলুন।”

পরিচয়পত্র নিয়ে কোনও চিন্তা নেই ওই ম্যানেজারের। বরং তাঁর আগ্রহ, সপ্তাহে তিন দিন সকালে উঠে বাজার করতে পারবে কি না নতুন আবাসিক। পারবে জেনে ম্যানেজার বলেন, “এখানে সব আবাসিক দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। সকালে উঠে বাজার যখন করতে পারেবন, তখন এই মেসে আপনার জায়গা পাকা। আগামী মাসে টাকা নিয়ে চলে আসবেন।” পরিচয়পত্রর প্রসঙ্গ তুলতে ঘার নেড়ে বলেন, “এই মেসে সকলেই ভদ্রলোক। পরে কোনও এক সময়ে দিয়ে দেবেন ভোটার কার্ড।”

উত্তর শহরতলির স্টেশন লাগোয়া এলাকার মতো দক্ষিণ শহরতলিতেও রয়েছে প্রচুর মেস। এ রকমই সন্তোষপুর এলাকার একটি মেসমালিক আবার জানালেন, সেখানে দিন পনেরো বা এক মাস থাকারও ব্যবস্থা আছে। দিন কয়েক থাকলে কোনও পরিচয়পত্র দরকার নেই। বেশি দিন থাকলে পরিচয়পত্র লাগবে।

বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে ভাড়াটে সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করছে পুলিশ। গেস্ট হাউস বা হোটেলে থাকতে গেলেও আবাসিকের পরিচয়পত্র লাগে। কিন্তু কলকাতা ও শহরতলির মেসবাড়িগুলির অধিকাংশরই নিরাপত্তার ঢিলেঢালা চিত্রটা প্রকট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি বর্ধমানের খাগড়াগড় কাণ্ডের পর বেশ কিছু জঙ্গি বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা পড়েছে। সেই সূত্র ধরে পুলিশও জানাচ্ছে মেসবাড়িগুলিতে কারা

আসা যাওয়া করছেন, সে ব্যপারে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার। এতে মেসমালিককেই বেশি সচেতন হতে হবে।

সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সচেতনতা যে দরকার, তা মানেন আবাসিকদের একাংশও। দমদমের একটি মেসের আবাসিক নীল মুখোপাধ্যায় জানান, পরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি উঠেছিলেন দমদমের একটি মেসে। কিন্তু কয়েক মাস সেখানে থাকার পরে কার্যত বাধ্য হয়েই বিমানবন্দর এলাকায় কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন তিনি। কেন? নীল বলছেন, “মেসের অন্য আবাসিকেরা কী করেন, সেটুকুও আমরা জানতাম না। মাঝেমধ্যে কিছু লোকজন আসছে, থাকছে আবার চলেও যাচ্ছে। রাতে আমার পাশের খাটে কে শুয়ে আছে, তা-ও অনেক সময়ে জানতাম না। এটা মোটেও স্বস্তির ছিল না।” কলেজ স্কোয়ার এলাকার একটি মেসের এক আবাসিক রাজা মজুমদার জানান, প্রথম বার মেসে আসার সময়ে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড ও প্যান কার্ড সঙ্গে এনেছিলেন তিনি। সেই সব পরিচয়পত্রের জেরক্সও করিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মেসমালিক সেগুলি কোনওদিনই চাননি। নিজেই উদ্যোগী হয়ে মেসমালিককে বলতে গেলে তাঁকে শুনতে হয়েছিল, ‘রেখে দিন। পরে নিয়ে নিলেই হবে। আপনার সঙ্গে তো পরিচয় হয়েই গিয়েছে।’

সম্প্রতি ক্রাইম কনফারেন্সে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্ত ভাড়াটে ও গেস্ট হাউসের আবাসিকদের তথ্য পুলিশের কাছে রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ভাড়াটে সম্পর্কে বা নবাগত কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব কি শুধু পুলিশের?

বিধাননগর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কুমার শঙ্কর সাধুর মতে, “দু’তরফেরই সমন্বয় থাকা দরকার। এই সমন্বয়ের খামতি আছে। নাগরিকদেরও একটা দায়বদ্ধতা আছে। তবে এই ব্যাপারে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে পুলিশকেই। তা হলেই সাধারণ মানুষ তথ্য সংগ্রহের কাজে সাহস পাবেন।” ‘বিধাননগর হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক সদস্য সমীর দাশগুপ্ত আবার স্বীকার করে নিলেন, “আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে শুধুমাত্র বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সমস্যার সমাধান করা হয়। পুলিশকে তথ্য দেওয়ার ব্যপারে এখনও সে ভাবে ভাবা হয়নি।” তবে পুলিশকে তথ্য দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

কলকাতা পুলিশের এক কর্তা স্বীকার করেছেন , ভাড়াটে সম্পর্কে পুলিশে তথ্য রাখার কাজ শুরু হলেও মেসের আবাসিকদের পরিচয়পত্র রাখার ব্যপারে খামতি রয়েছে। কারণ মেসে অনেক সময়েই এক জন আবাসিক অন্য কয়েক জনকে ঢুকিয়ে নেন। ফলে মূল আবাসিক কে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অজয় ঠাকুর মনে করেন, মেসে যাঁরা থাকেন, তাঁদের একটি ‘ডেটা ব্যাঙ্ক’ স্থানীয় থানায় থাকা দরকার। তিনি বলেন, “মাঝেমধ্যে পুলিশ শহরের মেস বাড়িগুলিতে হানা দেয় ঠিকই, কিন্তু আলাদা করে ‘ডেটা ব্যাঙ্ক’ তৈরি নেই। এটা জরুরি।”

বিধাননগর কমিশনারেটের এসিপি অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভাড়াটে সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য আমরা ফর্ম বিলি করেছি। এই পদ্ধতিতেই মেসবাড়িগুলির আবাসিকদের তথ্যও যতটা সম্ভব, সংগ্রহ করার কাজ শুরু করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন