কলকাতার পাইকপাড়া অঞ্চলের টালাপার্কে একটা তিন তলার ফ্ল্যাটে আমার জন্ম। জ্ঞান হবার পর থেকে এখানেই কেটেছে আমার শৈশব। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবেশের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। আমাদের পাড়া তখন ছিল খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির সামনে একটা পার্ক—মাঝখানে পুকুর। সেখানে শেখানো হত সাঁতার। পুকুরের মাঝখানে একটা ছোট দ্বীপ। পার্কের পাশেই ছিল ফুলের বাগান। সারা বছর ঋতু অনুযায়ী নানা রঙের ফুলে ভরে থাকত সেই বাগান। আমার রূপকথার গল্পে পড়া ছবির মতো মনে হত আমার পাড়াও আশেপাশের পরিবেশ। পার্কের মালিরা সন্ধেবেলা ঢোল নিয়ে যখন গান ধরত তখন পাড়াটা গমগম করে উঠত। দাদা তখন সাইকেল চালানো শিখতে পার্কে যেত আমিও দাদার পিছুপিছু দৌঁড়াতাম মায়ের সঙ্গে। কখনও বা বাবার সঙ্গে। রাতের বেলায় পার্কটা ঝলমল করে উঠত, মনে হত জীবনের সব আনন্দটুকু পার্কেই।
আমার দাদু কবি কাজি নজরুল ইসলাম। কাজী অনিরুদ্ধের ছোট মেয়ে আমি। বাড়িতে দাদু, মণি (ঠাকুমা) বাবা, মা থাকতেন। সঙ্গীতিক আবহে, সুরের মূর্ছনায় দিন কাটত। তাই গান ধীরে ধীরে হয়ে উঠল আমার প্রাণ। অনেকটা ভাললাগা, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও পরম্পরা রক্ষায় গান, আবৃত্তিকে অজান্তেই সঙ্গী করে ফেললাম। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভ করায় দাদুর গান, কবিতা বলার আগ্রহ যেন অনেকগুণ বেড়ে গেল। আমাদের পাড়ায় সংস্কৃতি জগতে বহু ব্যক্তিত্বের বাস ছিল। নরেন মিত্র, দাদুর শৈশবের সেতার বাদক মোস্তাক আলি খান, চিত্রপরিচালক তপন সিংহ প্রমুখ। প্রতিবেশীদের থেকে পেলাম অনেক স্নেহ ভালবাসা। সবাইকে সবসময় পাওয়াসহজ ছিল। দোল খেলা, সরস্বতীপুজো বা দুর্গাপুজোয় সকলে এক সঙ্গে উপভোগ করতাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এমনকি অংশও নিতাম। আমাদের ফ্ল্যাট-এ বাবা যখন গিটার বাজনার রিহার্সাল দিতেন তখন বাড়ির নীচে সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতারা ভিড় জমাত।
তার পর হঠাৎ চলে এলাম মামার বাড়ি দর্জিপাড়ায়। বাবার মৃত্যুর পর। উত্তর কলকাতা জায়গাটা একেবারে অন্যরকম। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরের দিকে ছিল আমাদের বাড়ি। দাদু ছিলেন স্থপতি। তাই আমার মামারবাড়ি এই ঘিঞ্জি এলাকায় ছিল একটু আলাদা ধরনের। কিন্তু বাড়ির সামনে বড় খেলার মাঠ ও পাড়ার ক্লাব ছিল। পার্কের মধ্যে ছিল একটা ফোয়ারা। রাতের বেলা সেই ফোয়ারায় আলো পড়লে মনে হত এ এক অন্য শহর। অনন্য কলকাতা। যার কথা বলেছি কবি, সাহিত্যকদের লেখায়।
কখনও গোয়েন্দা গল্পে। ছিল ফুলের বাগান। প্রতি বছর শীতকালে এখানে ফ্লাওয়ার শো হত। আর মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতা চলত। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সারা বছর ধরে গমগম করত আমাদের পাড়া। আমাদের বাড়ির নীচে রক ছিল যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা বসত— পাড়ার বয়স্ক মানুষদের, কখনও বা তরুণদের। বিষয় থাকত নানা রকম। রাজনীতি, ফুটবল, ক্রিকেট থেকে পরনিন্দা-পরচর্চা তা সে যাই হোক না কেন। পাড়ার মোড়ে মোড়ে জটলা, আড্ডা শুনতে পথচলতি লোকের থেমে যাওয়া পাড়ার পরিবেশটাই বদলে দিত। তাতে ছিল প্রাণ। হাসি-ঠাট্টা-তামাসা।
দেখতে দেখতে বদলে গেছে আমার পাড়া। চোখের সামনে আমার চেনা কলকাতা অনেক বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালবাসার স্পর্শ। এখন আর যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রতিভা খোঁজা হয় না। হয় বেশির ভাগটাই তাঁবেদারিতে। তাই অনেকের স্বপ্নই অধরা অপূর্ণ রয়ে যায় এই শহরে। পাড়ার বাড়িগুলো উত্তরাধিকারিদের অমনোযোগিতায় অবহেলায় অবাঞ্ছিত ব্যক্তিত্বের দখলে হারিয়েছে তাদের ঐতিহ্য। বনেদিয়ানা। এখন চাকচিক্য, আধুনিকতা হয়তো অনেক বেড়েছে। কিন্তু কমে গেছে অন্তরের টান হারিয়ে গেছে ছোটবেলায় রূপকথার গল্পের আমার সুন্দর পাড়া। যদিও সকাল সন্ধ্যা পরিষ্কার হওয়া পথঘাট, নিয়মিত জঞ্জাল অপসারণ, আলোকস্তম্ভের জোরালো আলো, কলকাতার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে ঠিকই, তবুও এই আলোর উল্টোদিকে এখনও জমে আছে অন্ধকার। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা কি তার সরলতার সৌন্দর্য হারিয়েছে? আমার হারিয়ে যাওয়া পাড়া ও কলকাতাকে আমার কাছে পেতে আমাদের নিজেদেরই অনেক সচেতন হতে হবে। কারণ স্মৃতিটুকুই আঁকড়েই আমরা বেঁচে থাকতে বোধহয় সবাই ভালবাসি। বিদেশি দেশ বাংলাদেশ আমার নিত্য যাতায়াত। কর্মসূত্রে বিদেশেও—সেখানকার সৌন্দর্য, আতিথেয়তা আমায় মুগ্ধ করেছে। আনন্দ আছে ঠিকই তবু ওখানে গিয়ে মনে হয়েছে অনেক অসুবিধা, মানসম্মান, দুঃখ নিয়েও আমার কলকাতা—আমার পাড়া আমার প্রিয় আশ্রয়—বার্ধক্যের বারাণসী, যাকে ধারণ করে বহন করে নিয়ে যেতে চাই। ভালবাসতে চাই নিবিড় কক্ষে সারাজীবন।
এই শহরই যে আমাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, চিনতে শিখিয়েছে, ভালবাসতে শিখিয়েছে।
লেখক নজরুলগীতি শিল্পী