এ ভাবেই বাড়ির একেবারে কাছে নেমে আসছে এক-একটি বিমান। ছবি: শৌভিক দে।
নামতে নামতে একেবারে যেন বাড়ির মাথায়! ঠোক্কর প্রায় লাগে লাগে!
আওয়াজের চোটে জানলার কাচ ঝনঝন করে উঠছে, পুরো দোতলা দালান থরথর করে কাঁপছে। বাড়ির লোকের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়!
ইদানীং কিছু পেল্লায় যাত্রীবাহী বিমানের এ হেন অধঃপতনের প্রবণতা দেখে বিমানবন্দর লাগোয়া ওই বাসিন্দাদেরও বুক কাঁপছে অজানা ত্রাসে। এত দিন ধরে এখানে বাস, কোনও বিমানকে তো এ ভাবে বাড়ির প্রায় কার্নিস ছুঁয়ে যেতে দেখেননি কেউ! “ভয় হয়, এই বুঝি বাড়ির উপরে ভেঙে পড়ে...!”
কথাটা বলার সময়েও ঘোর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে প্রদীপ ঘোষের চোখ-মুখে “এত নীচ দিয়ে যাচ্ছে যে, আমরা বাড়িতে বসে প্লেনের জানলা দিয়ে যাত্রীদের মাথা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি!” প্রদীপবাবুর পড়শি কেয়া বিশ্বাসের ভয়ার্ত প্রতিক্রিয়া, “আজকাল এত নীচ দিয়ে প্লেন যায় যে, গায়ে হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগে!”
ওঁরা কৈখালির দশদ্রোণ এলাকায় থাকেন। ‘পল্লবী ভিলেজ’-এ। উল্টো দিকে কলকাতা বিমানবন্দরের পাঁচিল। পাঁচিলের পরে দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত। অন্য দিকে পাঁচিলের পাশে পিচ রাস্তা ছাড়ালে চোখে পড়বে ছোট ছোট দোতলা বাড়িপ্রদীপবাবু, কেয়াদেবীদের ঠিকানা। দশদ্রোণের বাড়িগুলোর মাথা দিয়ে বিমান নামা নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইদানীং এক-একটা বিমান যেন একটু বেশিই নীচে নেমে আসছে! একেবারে ছাদের কাছাকাছি। আর এটা হচ্ছে মূলত শীতকালে, সপ্তাহে দু’-এক বার।
ঘটনাটা জেনে কলকাতা বিমানবন্দরের কর্তাব্যক্তিরা নড়ে-চড়ে বসেছেন। ওঁঁদের চিন্তা বাড়িয়েছে পাইলট এবং এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর পরস্পর-বিরোধী রিপোর্ট। অবনমনের গণ্ডি ছাড়ানো বিভিন্ন বিমানের পাইলটেরা জানাচ্ছেন, অবতরণের আগে তাঁদের ককপিটের মনিটরে বিমানের উচ্চতা, গতি বা রানওয়ের সঙ্গে দূরত্ব সংক্রান্ত সব মাপকাঠিই ঠিকঠাক দেখিয়েছে। অথচ এটিসি’র মনিটরের ছবি বলছে, ওই সময়ে বিমান নেমে এসেছিল লক্ষ্মণরেখার বিস্তর নীচে!
ধন্দ কাটাতে বিমানবন্দরের কর্তারা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তবু সমস্যা ধরা পড়েনি। শুধু বোঝা গিয়েছে, ঘটনাগুলো ঘটছে বুধ অথবা শুক্রবার। কোনও নির্দিষ্ট বিমান নয়। এক-এক দিন, এক-একটা বিমান এমন অদ্ভুত আচরণ করে বসছে। তথ্যটা প্রদীপবাবুদের অভিযোগের সঙ্গে খাপও খাচ্ছে। কী রকম?
সূত্রের খবর: রক্ষণাবেক্ষণের খাতিরে ফি সপ্তাহে বুধ-শুক্র দু’দিনই সকাল থেকে বিমানবন্দরের প্রধান রানওয়ে বন্ধ থাকে। তখন দ্বিতীয় রানওয়ে দিয়ে বিমান ওঠা-নামা করে। উপরন্তু শীতকালে হাওয়া উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যায়, আর বিমান সব সময় হাওয়ার উল্টোদিকে নামে। ফলে দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত ধরেই অবতরণ করতে হয়। মানে পল্লবী ভিলেজের দিক দিয়ে।
কিন্তু তা-ই বলে বিমান আবাসিক এলাকার বাড়ির ঘাড়ের উপরে এসে পড়বে কেন, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা রহস্যের কিনারা না-হওয়ায় কর্তাদের চিন্তা ক্রমে আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে। বিমান পরিবহণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এরও কপালে ভাঁজ। ডিজিসিএ-র দাবি, রোগ ধরতে চেষ্টার কসুর হচ্ছে না। দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে অবতরণকারী বিমানকে পথ দেখায় যে তিনটে যন্ত্র, খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোয় কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। দিল্লি থেকে বিমান এনে পরীক্ষামূলক ভাবে বারবার দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে নামানো হয়েছে। কোথাও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। “কখন কোন বিমানের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। পরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা তো দেখছি, সব যন্ত্র, সব রিডিং বিলক্ষণ ঠিকঠাক!” বিস্মিত মন্তব্য এক অফিসারের।
তা হলে কি ভুতুড়ে কাণ্ড? কর্তৃপক্ষের কাছে উত্তর নেই। ডিজিসিএ এখন ঠিক করেছে, দ্বিতীয় রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে আসা প্রতিটি বিমানের পাইলট লিখিত রিপোর্ট দেবেন। তা খতিয়ে দেখে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজবেন বিশেষজ্ঞেরা।
অর্থাৎ, আকাশে আওয়াজ শুনলে আপাতত ভয়ে সিঁটিয়েই থাকতে হবে প্রদীপবাবুদের। এই বুঝি...।