খোলা বাজারের থেকে কম দামে গৃহস্থের হাতে সব্জি পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। এ জন্য কলকাতা পুরসভার ব্যবস্থাপনায় শহরের কিছু জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রিকশা ভ্যান। অথচ ন্যায্য মূল্যে সব্জি নিয়ে সেই রিকশা ভ্যান কখন, কোথায় পৌঁছবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও হদিস কার্যত দিচ্ছে না সরকার বা পুরসভা কেউই। উল্টে ক্রেতারা যখন রোজকার সব্জি কেনাকাটায় শহরের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছচ্ছেন, তখন সেখানে সব্জি মিলছে সরকারি দরের অন্তত দ্বিগুণ দামে।
কলকাতায় ৩৫৮টি বাজার রয়েছে। এর মধ্যে পুর-বাজারের সংখ্যা ৪৬। সরকার ন্যায্য মূল্যে সব্জি বিক্রির ব্যবস্থা করলেও এই বাজারগুলিতে সব্জির দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। শহরবাসীর আশা ছিল, অন্তত পুর-বাজারগুলিতে সব্জির দাম কমবে। তা তো হয়ইনি, বরং যেখানে সরকার এক কেজি পটল ১৪ টাকায় কিনে বেচছে ১৬ টাকায়, ঝিঙে ১৪ টাকায় কিনে বেচছে ১৮ টাকায়, সেখানে সেই পটল ও ঝিঙে একই দামে কিনে ৩০ টাকা দাম নিচ্ছে পুর বাজার-সহ সব বাজারই। ২২ টাকা কেজি লঙ্কা সরকার বেচছে ২৮ টাকায়। আর বাজারগুলোতে ক্রেতাদের তা কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা কেজি প্রতি। এমনকী, কলকাতা পুরসভার নিজস্ব বাজারগুলিতেও সরকারি দরের দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে কুমড়ো, লঙ্কা, উচ্ছে, পটল, ঝিঙে। সম্প্রতি পুরসভার বাজার দফতর কোলে মার্কেটে সব্জির দর যাচাই করতে গিয়ে এই তথ্য জানতে পেরেছে। তার পরেই গত ৩ জুলাই থেকে কোলে মার্কেটে তাদের কেনা সব্জির দাম, বিভিন্ন ওয়ার্ডে বেচার দাম এবং অন্য বাজারে সব্জির দামের তালিকা বানানোর কাজ শুরু করেছে পুরসভা।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সরকার যে দামে বিক্রি করছে, সেই দর তাঁদেরই নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলি মানছে না কেন? এর কোনও স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি পুর বা রাজ্য কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা। বরং তাঁদের কথায়, কোলে মার্কেট থেকে যে দামে তাঁরা ওই সব সব্জি কিনছেন, সেই দামেই অন্যান্য বাজারের দোকানদারেরা কিনছেন। ৩ জুলাইয়ের তালিকা অনুযায়ী তাঁদের হিসেবেই, প্রতিটি সব্জির দরে কমপক্ষে ৬০ থেকে ১৫০ শতাংশ লাভ রেখে বিক্রি করছেন মানিকতলা, গড়িয়াহাট, বেহালা বুড়োশিবতলার বিক্রেতারা।
এতখানি লাভ কেন? পুর বাজার-সহ সমস্ত বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে যে ক্ষমতা দরকার, তা পুর-আইনে নেই বলে জানিয়েছেন পুর-বাজার দফতরের এক অফিসার। এনফোর্সমেন্ট শাখা নিয়মিত অভিযান চালালে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে তাঁর ধারণা।
নবান্ন সূত্রের খবর, সব্জির ক্রমবর্ধমান দামের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি টাস্ক ফোর্সের এক বৈঠকে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে রিকশা ভ্যানে ন্যায্য মূল্যে সব্জি বিক্রির নির্দেশ দেন। তবে আপাতত কলকাতা পুর-এলাকার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটি বরোর মাত্র ১২টি ওয়ার্ডের কিছু এলাকায় এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কলকাতা পুরসভার স্ব-রোজগার যোজনা প্রকল্পে যে সব বেকারেরা নাম লিখিয়েছেন, তাঁরাই ওই সব্জি বিক্রি করবেন। কোলে মার্কেট থেকে পাইকারি দরে সব্জি কিনে পুরসভা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবে। ওই সব্জির পসরা ওয়ার্ড এলাকায় নিয়ে যেতে তিন চাকার রিকশা ভ্যানও দিচ্ছে পুরসভা। তবে মালের দাম মেটাতে হবে ওই যুবকদেরই। লাভ নেবেন তাঁরাই।
নতুন ব্যবস্থায় আপাতত শ্যামবাজার, উল্টোডাঙা, কাঁকুড়গাছি, গল্ফগ্রিন, রাসবিহারীর কিছু এলাকায় রিকশা ভ্যানে সব্জি বেচা শুরু করেছেন কিছু বেকার যুবক। পুরসভা সূত্রের খবর, এ ছাড়াও খুব শীঘ্রই নিউ মার্কেট (হগ মার্কেট), এন্টালি, উল্টোডাঙা, গড়িয়াহাট, মার্কাস স্কোয়ার (কলেজ স্ট্রিট), ল্যান্সডাউন, বাঁশদ্রোণী-সহ ১৪টি বাজারে ২৩টি নায্য মূল্যের সব্জি দোকান খোলা হবে।
শহরের অল্প কয়েকটি ওয়ার্ডে সরকার ও পুরসভার এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। কলকাতা পুরসভার বিরোধী দল কংগ্রেসের মালা রায় এবং সিপিএমের রাজীব বিশ্বাসের বক্তব্য, “গোটা কয়েক ওয়ার্ডে ন্যায্য মূল্যে সব্জি বিক্রির ব্যবস্থা করে পুর-ভোটের আগে বাহবা কুড়োতে চায় সরকার। কিন্তু এখন দরকার পুর বাজার-সহ সব বাজারে সব্জির দাম নিয়ন্ত্রণ।”
মেয়র পারিষদ (বাজার) তারক সিংহ বলেন, “পুরো কলকাতায় এই ধরনের ভ্যান দিয়ে সব্জি পৌঁছনোর মতো পরিকাঠামো এখনও নেই পুরসভার। ন্যায্য মূল্যে সব্জি বেচার এই উদ্যোগ মূলত ব্যবসায়ীদের বার্তা দিতে, যেন তাঁরাও এই দামে সব্জি বিক্রি করেন। তবে লাভের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা যাতে মার না খান, সে দিকেও লক্ষ রাখা হবে। ব্যবসায়ীরা না মানলে ৪৬টি পুর-বাজার থেকেই এমন ব্যবস্থা করতে হবে।”
তবে সরকারি প্রচেষ্টা প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য বলে মনে করছেন সরকারি অফিসারদেরই একাংশ। কেউ কেউ বলেন, নায্য মূল্যের ব্রয়লার মুরগি বিক্রির দোকান খুলে তার দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। সব্জির ক্ষেত্রেও তা করতে চায় সরকার। যদিও এর জন্য নিয়মিত নজরদারি জরুরি। তবে বাস্তবে তা সম্ভব কি? সামনেই পুর-ভোট। অনেকের মতে, তার আগে ব্যবসায়ীদের চটাতে চায় না পুর-প্রশাসন। সে দিকে লক্ষ রেখেই কিছু এলাকায় কয়েকটি নায্য মূল্যের সব্জি দোকান খুলে সরকার দর নিয়ন্ত্রণের বার্তা দিতে চায় বলে মনে করছেন অনেকেই।