চেনা গলি পেরিয়ে হালিমের জয়যাত্রা নতুন পথেও

বিশ্বায়ন যদি হতে পারে, কলকাতায়নই বা হবে না কেন? কয়লার আঁচে তপ্ত ঢাউস এক হাঁড়িতে উপচে ওঠা তরলের সৌজন্যে এই প্রশ্নটাই উঠে আসছে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৫
Share:

বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বিকোচ্ছে হালিম। বৃহস্পতিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

বিশ্বায়ন যদি হতে পারে, কলকাতায়নই বা হবে না কেন?

Advertisement

কয়লার আঁচে তপ্ত ঢাউস এক হাঁড়িতে উপচে ওঠা তরলের সৌজন্যে এই প্রশ্নটাই উঠে আসছে।

রমজান মাসে এ হাঁড়িতে কী মেলে, কলকাতাবাসীকে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। রসিক নাগরিক এখন ‘হা’ বললেই হালিম বুঝে যাবেন। থকথকে ডালে ভরপুর মাংসের টুকরো। সাধারণত বছরের এই একটি মাস, স্রেফ বিকেলের ক’ঘণ্টা তার দেখা মেলে। রমজান মানে এ শহরের বহু নাগরিকের কাছেই হালিম ঋতু। তিনি হতে পারেন রোজানিষ্ঠ মুসলিম, কিংবা অন্য কোনও ধর্মের মানুষ, বিকেলের ইফতারের সময়টা হাঁড়ি বোঝাই সেই সুখাদ্যের জন্য প্রাণ আনচান করবেই।

Advertisement

তবে, এতদিন শহরের কয়েকটি নির্দিষ্ট মহল্লায় শুধু তার দেখা মিলত। যেমন পার্ক সার্কাস, পার্ক স্ট্রিট, ধর্মতলা, খিদিরপুর, জাকারিয়া স্ট্রিটের মতো পাঁচমিশেলি পাড়া বা মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা। এই রমজানে সে গণ্ডি ছাড়িয়ে হালিম এখন উত্তরে বা দক্ষিণে, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। হালিমের নতুন ঠিকানা হাতিবাগান, গোলপার্ক, তারাতলা, অজয়নগর বা নাগেরবাজারও।

তাতে চমৎকৃত এ শহরের পোড়খাওয়া খাদ্যসন্ধানী নন্দন বাগচী। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে, প্রথম হালিমের সঙ্গে ভাব হয়েছিল, পার্ক স্ট্রিট লাগোয়া কলকাতা-১৬ পিন কোডের এলাকায়। ইলিয়ট রোড, রিপন স্ট্রিটের রমজানি বিকেল মানেই নানা কিসিমের কাবাব, ভাজাভুজি ও অবশ্যই হালিমের সুঘ্রাণে ভরপুর। হালিম আদতে ধর্মনিষ্ঠ মুসলিমের সান্ধ্য রোজাভঙ্গ বা ইফতারি আহারের উপকরণ। কিন্তু যে কোনও ভোজনরসিকেরই তা পরম প্রাপ্তি। আবার ডায়েটিশিয়ানদের অনেকেরই মত, বিচিত্র খাদ্যগুণের মিশেলে হালিম আদতে একটি সম্পূর্ণ আহার।

রকমারি ডাল ভিজিয়ে রেখে হালিমের সাধনা শুরু হয় আগের রাতেই। এর পরে কয়েক ঘণ্টা ধরে ফুটোনো ডাল, গম, মাংস ও কিছু গোপন মশলার তুকতাকে তার জন্ম পরের দিন দুপুরে। সান্ধ্য আজানের ধ্বনির আবহে ধোঁয়া-ওঠা বাটিতে চুমুক দেওয়ার স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা অনেকেই ভুলতে পারেন না।

এই রমজানে সে অভিজ্ঞতাটা ব্যাপ্ত কলকাতাময়। গোমাংস যাঁদের রোচে না, তাঁদের জন্য শহরের বিভিন্ন হেভিওয়েট মোগলাই ঠেকে মাটন হালিমের চর্চা শুরু হয়েছে, বহু বছর আগেই। চিকেন হালিমের জনপ্রিয়তাও ক্রমশ বাড়ছে। এ বার মোগলাই খানার নামী ব্র্যান্ডগুলি শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিত্যনতুন আউটলেট খুলছে। এই রমজানে হালিমের খোশবাইও ছড়িয়ে পড়ছে সেখানে। কলকাতা ছাড়িয়ে মফস্সলের কিছু হোটেলেও হালিমের বেশ কদর।

অথচ, বাঙালি মুসলিম ঘরেও হালিমের চল খুব পুরনো নয়। মালদহের ছেলে, অধুনা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের গবেষক শাহনওয়াজ আলি রায়হানের কথায়, “আমি বড় হয়ে কলকাতায় এসেই প্রথম হালিম দেখেছি! কিছুটা উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের প্রভাবেই পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে হালিম ঢুকে পড়েছে।”

মোগলাই বা লখনউয়ি খানার কলকাতা পাড়ি দেওয়ার পিছনে যাঁর ভূমিকা ইতিহাস-স্বীকৃত, সেই নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের উত্তরপুরুষ, পার্কসার্কাসবাসী শাহানশাহ মির্জা অবশ্য হালিমের জনপ্রিয়তায় অবাক নন! হেসে বলছেন, “হবে না-ই বা কেন! বিরিয়ানি, বড়দিনের কেক বা মোমোর ক্ষেত্রেও তো এমনটা ঘটেছে।”

বাস্তবিক, মোগলাই বিরিয়ানি এখন মোটেও খানদানি বাবুর্চির একচেটিয়া নয়। বিয়েবাড়ির কেটারারের মেদিনীপুরি বা উৎকলজাত রাঁধুনের হাতেও তা দিব্যি খুলছে। আবার বড়দিনের কেক কিনতেও পার্ক স্ট্রিট, নিউ মার্কেট যেতে হচ্ছে না। নিউ আলিপুর, বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট, সল্টলেক থেকে শুরু করে সর্বত্র বেকারি, কনফেকশনারির ছড়াছড়ি।

এ শহরে মোমোর প্রসারও কম যায় না! সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ পড়তে গিয়েই মোমো খায় না মাথায় দেয়, প্রথম জেনেছিল বাঙালি। সেখানে বর্ণনা ছিল, মিটবল্স ইন সস! এলগিন রোডের কাছে গুটিকয়েক নেপালি পরিবারের হাত ধরেই এ শহরে মোমোর পথ চলা শুরু। এখন তা পাড়ায়-পাড়ায় তেলেভাজা-শিঙাড়ার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে।

কলকাতার হালিমও ক্রমশ সর্বজনীন হয়ে উঠছে বলেই দাবি করছেন মোগলাই রেস্তোরাঁর কর্তাব্যক্তিরা। সিরাজের কর্ণধার ইশতিয়াক আহমেদ বলছিলেন, “এখানে হালিমের সমঝদারদের অর্ধেকই দেখছি মুসলিম নন।” কলকাতার চেনা হালিমের সঙ্গে সিরাজে এ বার দেখা যাচ্ছে নানা রকমফের। ডালে মাংসের টুকরোর বদলে গলানো মাংস (হায়দরাবাদি) কি মাংসের কোফতার (আফগানি) হালিমও চেটেপুটে খাচ্ছে কলকাতা। আরসালানের ডিরেক্টর আখতার পারভেজ বা আমিনিয়ার কর্তা আশার আথারেরও অভিজ্ঞতা, গত দশ বছরে হালিমপ্রেমীদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। দোকানের সব আউটলেটেই হালিমের চাহিদা। কলকাতার হালিম-মানচিত্রও অতএব ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন