ঘিঞ্জি গলির ভিতরে একচিলতে জমি। সেখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গোটা বিশেক মোষ এবং খান দশেক গরু। তাদের সামনে বাঁধানো চৌবাচ্চায় রয়েছে জল। কয়েকটি চৌবাচ্চায় রাখা জাবনা।
কোনও গ্রামের দৃশ্য নয়। খাস কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অদূরে লতিফ স্ট্রিটে কংক্রিটের বহুতলের মাঝখানে দিব্যি চলছে এই খাটাল। সেখানে জাবর কেটে চলেছে গরু-মোষ। এখান থেকে দুধ যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়।
শুধু লতিফ স্ট্রিটেই নয়, একই চিত্র লেক গার্ডেন্সেও। উড়ালপুলের নীচে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি গরু এবং মোষ। জমি জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় রাখা খড়। কোথাও বা জলের বড় বড় গামলা। দেওয়াল জুড়ে ঘুঁটে। এখানে যে খাটাল রয়েছে, বাইরে থেকে দেখে চট করে বোঝা যায় না। পাশেই একটি বহুতল। লেক গার্ডেন্স উড়ালপুল দিয়ে লেক গার্ডেন্সে ঢুকতে গেলে এই জমির পাশ দিয়েই যেতে হয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তায় ঢোকার মুখে এই ধরনের খাটাল রয়ে গিয়েছে বহু বছর ধরেই।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কাছে
লেক গার্ডেন্স
গল্ফ গার্ডেনেও দেখা গেল একই দৃশ্য। সেখানে ফুটপাথে গরু বাঁধা। আছে তার খাবারের পাত্রও। গোবর ছড়িয়ে ফুটপাথে। কয়েক পা দূরেই রংকল কলোনি সংলগ্ন এলাকাতেও দীর্ঘ দিন ধরে একটি খাটাল চলছে। গল্ফগ্রিন সংলগ্ন অরবিন্দনগরেও পাড়ার মধ্যে দিব্যি চলছে খাটাল।
গঙ্গার ধারে হেস্টিংসের ক্যানাল রোডে সেচ দফতরের জমিতেই সার বেঁধে গোটা তিনেক খাটাল গজিয়ে উঠেছে। ঝুপড়ির বাইরে থেকে এমন করে প্লাস্টিক টাঙানো রয়েছে যে, ভিতরে থাকা গরু-মোষের উপস্থিতি বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। ভিতরে সবার অলক্ষ্যে চলছে খাটাল।
কলকাতা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন অজস্র খাটাল। কোথাও পাঁচিল দিয়ে ঘিরে, কোথাও টিনের চাল আর বেড়া ঘেরা জায়গায়। কোথাও আবার বস্তা দিয়ে ঢেকে চলছে খাটালের কারবার। আইন অনুযায়ী, শহরে খাটাল নিষিদ্ধ। শহরবাসীদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল রাজ্য সরকার। তা সত্ত্বেও এই ধরনের খাটালের রমরমা বহাল রয়েছে।
খাটাল থেকে কী কী সমস্যা হতে পারে স্বাস্থ্যের? পরজীবী-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী বলেন, “গরুর গায়ে এক ধরনের মাছি থাকে যা মানুষকে কামড়ালে অ্যালার্জিজনিত রোগ হতে পারে।” পরিবেশবিদ মোহিত রায় বলেন, “আমাদের শহরে উন্নতমানের বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। খাটালের বর্জ্য থেকেও নানা ধরনের দূষণ ছড়ায়।” পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের বক্তব্য, “গরু-মোষের বর্জ্য শহরের নিকাশি ব্যবস্থাকে নষ্ট করে, দুর্গন্ধে বায়ুদূষণ হয়। নোংরা ছড়ায়।”
কিন্তু শহরে খাটাল সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা যাতে মেনে চলা হয়, তা দেখার দায়িত্ব কার? পুলিশ জানিয়েছে, নিয়াম অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনও অভিযোগ এলে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে বিষয়টি প্রাণিসম্পদ দফতরকে জানায়। প্রাণিসম্পদ দফতর সরাসরিও খাটালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পুরসভা এবং পুলিশের সহযোগিতা নিতে পারে প্রাণিসম্পদ দফতর।
গল্ফ গ্রিন
হেস্টিংস
কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (রিজার্ভ ফোর্স) অশোক বিশ্বাস বলেন, “দিন কয়েক আগেই আমরা শহরে বেশ কয়েকটি খাটালের ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ দফতরকে জানিয়েছি। এর পরে ওই দফতর খাটালের মালিকদের নোটিস দেবে। তাতে কাজ না হলে আমাদের উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দেবে। কিন্তু এমন কোনও নির্দেশ আমরা পাইনি।”
কী বলছে প্রাণিসম্পদ দফতর? রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “পুলিশ শহরে খাটালের তালিকা পাঠিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে আধিকারিকদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করে আমাদের দফতর যা ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নেবে।”
কলকাতা পুরসভার জঞ্জাল দফতরের মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদারও বলেন, “প্রাণিসম্পদ দফতর উচ্ছেদ অভিযানে সাহায্য চাইলে আমরা তা করব। কিন্তু এখনও কোনও সহায়তা চাওয়া হয়নি।” বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে, তা নিয়ে এই চাপান-উতোরের মাঝে দিব্যি চলছে খাটাল। হেস্টিংসের একটি খাটালের মালিক রামনাথ রায় বলেন, “এখানে এই জমি খালি পড়ে ছিল। সেই কারণেই এখানে গরু-মোষ এনে রাখি। মাঝখানে প্রশাসন থেকে সরে যেতে বলেছিল। কিন্তু যাব কোথায়?” লতিফ স্ট্রিটের খাটালের মালিক মহম্মদ জুয়েলের কথায়, “প্রশাসনের সকলেই তো আমার খাটালের কথা জানেন। আমায় তো কেউ উঠতে বলেননি!”
ছবি: সুমন বল্লভ ও রণজিৎ নন্দী