সরস্বতী পুজোর দিন থেকে শুরু হয়েছে মাইকের দাপট। আর থামেই না। বুধবার সন্ধ্যায় ছেলেকে বললাম, বাবু এ বার ওদের একটু থামতে বল। চার দিন ধরে ঘুমোতে পারছি না। বাবু বলল, “মা আজকে বোধহয় ওরা থেমে যাবে। আজ ভাসান। তুমি শুয়ে পড়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করো।”
শুলাম ঠিকই। কিন্তু রাত এগারোটাতেও মাইকের তাণ্ডব থামার কোনও লক্ষণ নেই। অগত্যা দু’কানে তুলো গুঁজে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠিক মতো ঘুম আসছিল না। ঘণ্টাখানেক পরে যেই একটু তন্দ্রার মতো এসেছে, তখনই হঠাৎ গানের আওয়াজটা আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন আওয়াজটা আমার ঘরের বারান্দার নীচ থেকেই আসছে। শুধু গানই নয়, সেই সঙ্গে ছেলেদের উল্লাস আর চিৎকার-চেঁচামেচি। বুকে ব্যথা শুরু হল আমার। মনে হচ্ছিল যেন হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। কোনও মতে টলতে টলতে বিছানা থেকে উঠলাম।
কয়েক মাস আগে আমার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল। এখনও ধরে ধরে হাঁটতে হয়। ঘড়িতে দেখলাম রাত রাত পৌনে একটা। অন্ধকারে কোনও রকমে হাঁটতে হাঁটতে ছেলের ঘরে পৌঁছলাম। ছেলেও তখন শব্দের তাণ্ডবে ঠিক মতো ঘুমোতে পারছিল না। বললাম, বাবু ওদের থামতে বল। আমি আর পারছি না। অসুস্থ হয়ে পড়ছি। বাবু বিছানা থেকে উঠে বলল, “মা তুমি শুয়ে পড়। আমি দেখছি।” তার পরে বারান্দায় গেল ওদের কিছু বলতে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখি, ওরা ভাসানে বেরিয়েছে। আমাদের ফ্ল্যাটের নীচেই একটা ম্যাটাডরের মতো গাড়িতে গান বাজাচ্ছে। বাবু ওদের বলল, “তোমরা এ বার একটু গানটা থামাও। আমার মা অসুস্থ। ঘুমোতে পারছে না।”
ওরা কিন্তু গান থামায়নি। শুনলাম, ওরা বলছে ডিজের গান সারারাত চলবে, থামবে না। সেই সঙ্গেই কানে এল অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। আমার ওখানে থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে বারান্দা থেকে সরে এলাম। জল খেয়ে সবে বাথরুমে গিয়েছি, আচমকা কাচ ভাঙার আওয়াজ। কী হয়েছে, প্রথমে বুঝতে পারিনি। কোনও রকমে ঘরে ফিরে দেখি, জানলার কাচ ভাঙা। বিছানার পাশে মেঝেতে একটা আধলা ইট পড়ে রয়েছে। আমি বিছানার যে দিকে মাথা দিয়ে শুয়েছিলাম, তার ঠিক পাশেই। তার মানে আমি যদি তখন শুয়ে থাকতাম, ইটের টুকরোটা আমার মাথাতেই এসে লাগত। ভাগ্য ভাল থাকলে বড়জোর হয়তো মশারিতে আটকে যেত।
ইতিমধ্যে শুধু আমার ঘরেই নয়, পাশের ঘরগুলো থেকেও কাচ ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছি। টলতে টলতে গিয়ে ছেলেকে বললাম, বাবু কী হচ্ছে এ সব? তুই আর ওদের সঙ্গে কথা বাড়াস না। ততক্ষণে আমার স্বামী বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে নীচের লোকগুলোকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! হঠাৎ দেখি, লম্বা চুলের এক ছায়ামুর্তি আমাদের গ্রিল বেয়ে উঠছে। হাতে ইটের টুকরো। আমরা সবাই ভয়ে ছিটকে গেলাম। সেই ইটের টুকরো আমাদের স্টোর-রুমের জানলার কাচ টুকরো টুকরো করে দিল। তখন আর আমাদের বারান্দায় দাঁড়ানোর সাহস ছিল না। বাইরে থেকে হুঙ্কার ভেসে আসছে, আমার ছেলেকে কে যেন বলছে ‘তোকে খুন করে ফেলব। বাইরে আয়।’ সেই সঙ্গে মত্ত লোকগুলোর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি। দমদম থানায় ফোন করতে শুরু করল আমার ছেলে। কিন্তু কোথায় পুলিশ! আমরা তিন জন তখন ঘরের মধ্যে কাঁপছি। আমাদের ফ্ল্যাটের নীচে থাকেন রথীনবাবু, প্রণববাবুরা। ওঁদের ফোন করলাম। ওঁরা বললেন, “আমরাও জেগে আছি। চিন্তা করবেন না। তবে বাইরে কোনও ভাবেই বেরোবেন না। থানায় ফোন করছি।”
এ দিকে, পুলিশ শুধু বলে যাচ্ছে, সাদা পোশাকের পুলিশ পাঠাচ্ছি। কিন্তু কোথায় কে! বেশ কিছুক্ষণ পরে বাইরের আওয়াজটা হঠাৎ কমে এল। সাহস করে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম একটা পুলিশের জিপ সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। মনে একটু বল এল। পুলিশ তা হলে চলে এসেছে! জিপটা কিন্তু থামল না। সোজা বেরিয়ে গেল।
পুলিশের জিপটা দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে যেতেই ফের শুরু হল তাণ্ডব। এ বার যেন দ্বিগুণ। শুরু হল ইট বৃষ্টি। সঙ্গে দরজায় দড়াম দড়াম করে লাথির আওয়াজ। আমরা তিন জন ভয়ে সোফার পাশে গিয়ে লুকোলাম। মনে হচ্ছিল কেউ যেন দরজাটাই ভেঙে ফেলবে! ওরা ঘরে ঢুকে পড়লে কী হবে ভেবে আতঙ্কের স্রোত বইতে শুরু করল। আমাদের বিপদ তো বটেই, বাড়িতে আমার স্বামীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা নানা ধরনের পুতুল রয়েছে। সেগুলোরই বা কী হবে? ছেলে ফের পুলিশকে ফোন করল। এ বারও অবশ্য লাভ হয়নি।
রাত তিনটে পর্যন্ত এ ভাবেই কেটে গেল। তিনটের পরে আওয়াজটা থেমে গেল। মনে হল ওরা ক্লান্ত হয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু অত ভোরে থানায় যেতে সাহস পাচ্ছিল না ছেলে। রথীনবাবুরা ততক্ষণে উপরে আমাদের ঘরে চলে এসেছেন। ওঁরাই বললেন, “আলো ফুটলে থানায় যাব। বেরোলেই যদি ফের ওরা হামলা করে!” আমিও ছেলেকে বললাম, আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।
সকাল হল। প্রতিবেশীদের নিয়ে ছেলে থানায় গেল অভিযোগ জানাতে। সকালের আলোয় দেখলাম ঘরের অবস্থা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইটের টুকরো পড়ে। আর গোটা ঘরে কাচের টুকরো। জানলার পাশে র্যাকে রাখা আমাদের সাধের রেকর্ডগুলো বেঁচে গিয়েছে বটে, তবে সেখানেও কাচের টুকরো।
নিজের শহর, নিজের পাড়া, সেখানেই এমন! আতঙ্ক যেন এখনও তাড়া করছে।
—নিজস্ব চিত্র