বাংলা মনের অ্যাংলো ঘরানা

চিকেন নিয়ে আদিখ্যেতার যুগে রেডমিটের এমন স্বাদ ভুলতে বসেছে কলকাতা। কষাটে সুরায় জারিত এই তুলতুলে ছাগমাংস নড়বড়ে দাঁতের বৃদ্ধও কব্জা করে ফেলবেন। রসালো মরিচদীপ্ত মাংস চাখতে চাখতেই প্রাণের পরে দোলা লাগায় হাল্কা রোজমেরির সুবাস! পাঁজরার হাড়ে লেগে থাকা মাংস ও মশলার এমন বিবাহ কদাচ সুসম্পন্ন হতে দেখা যায়।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

চিকেন নিয়ে আদিখ্যেতার যুগে রেডমিটের এমন স্বাদ ভুলতে বসেছে কলকাতা। কষাটে সুরায় জারিত এই তুলতুলে ছাগমাংস নড়বড়ে দাঁতের বৃদ্ধও কব্জা করে ফেলবেন। রসালো মরিচদীপ্ত মাংস চাখতে চাখতেই প্রাণের পরে দোলা লাগায় হাল্কা রোজমেরির সুবাস! পাঁজরার হাড়ে লেগে থাকা মাংস ও মশলার এমন বিবাহ কদাচ সুসম্পন্ন হতে দেখা যায়।

Advertisement

স্বাস্থ্যসচেতনতার নামে মাটন-বিসর্জনের যুগে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, ওহ্ ক্যালকাটার এই ‘ল্যাম্ব চপ’। কলকাতার বচ্ছরকার শীত-পার্বণে ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ফুড ফেস্টিভ্যাল’-এর হাত ধরে যার জন্ম হয়েছে। মেনুতে স্টার্টার বলে পরিচিতি থাকলেও একুশ শতকের বাঙালি চাইলে ছক ভাঙতেই পারেন। চমচম-রসগোল্লার মতো রসালো মাংস, লুচির সঙ্গে খেলেও বেমানান হবে না। ঝাউতলা রোডের আফজা রেস্তোরাঁয় যে দুর্দান্ত মাটন নাল্লি গোস্ত মেলে কমনীয়তার মাপকাঠিতে তার সঙ্গে অবশ্যই তুলনীয় তরুণ খাসির পাঁজরার হাড়ের এই টুকরো।

রেডমিট যাদের রোচে না, ওহ্ ক্যালকাটার উৎসবে তাঁরা চিকেন অ্যাসাডোর শরণাপন্ন হতে পারেন। অ্যাসাডো বস্তুটি আদতে চিকেন রোস্ট গোছের। কিন্তু এ যাত্রা সেই রোস্টের ভোল পাল্টে গিয়েছে। রোস্ট করা চিকেন হাড় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে টিকিয়ার মতো মাখা হয়েছে। গ্রিল করা রসালো চিকেন টিকিয়ায় মিশেছে মরিচের তীব্রতা ও লেবুপাতার সুবাস।

Advertisement

তবে এ সব সৃষ্টি খাঁটি ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য এড়ানো যাচ্ছে না।

কলিন স্ট্রিটের ভারী অতিথিবৎসল পিসিমা পামেলা রিবেইরো বলছিলেন, একদম হুবহু এই ধরনের রেসিপি তাঁর মা-দাদির অস্ত্রশালায় ছিল না। “তখন রোজমেরি, থাইমের নাম কে শুনেছিল?” হেঁসেলে ভিনিগার-ওয়াইনের চর্চা করলেও গড়পরতা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘর বরাবরই জিরে-ধনে-আদা-রসুন-পেঁয়াজ-হলুদ-গরম মশলার ছকেই তার জাদু সৃষ্টি করেছে। বছর চারেক আগে পার্ক হোটেলের দ্য ব্রিজ রেস্তোরাঁয় পামেলা আন্টির সৃষ্টি পর্ক ভুনি, ভিন্দালু বা মাংসের হুসেনি কারি হই হই ফেলে দিয়েছিল।

বড়দিনের মরসুমে রসনার এই অ্যাংলো ঘরানা বরাবরই ধাক্কা দেয় মূল স্রোতের রেস্তোরাঁর হেঁসেলে। শীতেই দিব্যি জমে অলিপাবে পানীয়ের সঙ্গে রকমারি মাংসের মিক্স গ্রিল। মোক্যাম্বোর টেট্রাজিনি, আলা কিয়েভ উপভোগেরও এটাই সেরা সময়। দ্য পিপাল ট্রি-র শেফ চিরঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর বুফেয় উদ্বৃত্ত মাংসের মাখো-মাখো ঝালফ্রেজি বা মাটন কোফতার বল কারিতে জোর দেন। সঙ্গে পার্সলি, সেলেরি বিশিষ্ট খণ্ডখণ্ড ইংলিশ পরোটা।

ওহ্ ক্যালকাটার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রান্নার খানিকটা ভিন্ন দর্শন। “নস্ট্যালজিয়া ও নতুন যুগের মনকোনওটাই ফেলনা নয়।”--- বললেন রেস্তোরাঁর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। এ তল্লাটে পর্ক-বিফের অনুপ্রবেশ নেই। অ্যাংলো-ঘরের বিখ্যাত বল কারি মাটন কোপ্তায় সৃষ্টি। ক্লাসিক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শৈলীর ছোঁয়াচ আছে বেশ কয়েকটি পদেই। শেফ সুবীর দেব তরিবত করে সৃষ্টি করেছেন নধর পিকিং ডাকের ভুনা। জিরে, ধনে, পেঁয়াজের দেশি কসরত মাত্রা পেয়েছে রেড ওয়াইনের মহিমায়। কিংবা ‘ডেকার্স লেন চিকেন রোস্ট’ বা মাটন ফ্রিটাথ কারি। গরম মশলার সঙ্গে কিছু বিদেশি হার্বও মিশেছে তাতে। ভেতো বাঙালির জন্য আদর্শ, এমন সুগন্ধী ঝোল-ঝোল মাংস পাতে পড়লেই খিদে চার গুণ চাগিয়ে ওঠে।

এক কালে অফিসপাড়ার অলি-গলিতে এ সব কারি বা স্টুয়ের কৌলীন্য ছিল। এখন ফাস্টফুড রোল-চাউমিনের দাপটে তা প্রায় উধাও। শহরের কাফে-কেবিনে সুলভ ছিল ব্রেডপুডিং বা মাংসের পুরভরা ভাজা পাটিসাপ্টা তথা প্যানথেরাস। রসনার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পন্থা তাদেরও ফিরিয়ে দিচ্ছে। কিছু ধ্রুপদী ইউরোপিয়ান রান্নাও আসরে সামিল। এ যেন বছর শেষে বুড়ো মা-বাপের কাছে দূর প্রবাসী ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের ঘরে ফেরা। সাবেক কলকাতার রিপন স্ট্রিট, কলিন স্ট্রিটের ম্যাড়মেড়ে মহল্লায় যখন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন