বন্ধ হয়ে যাওয়া সারদার দফতর। বেহালায়। ছবি: শুভাশিস ঘটক।
সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার নামে কলকাতায় একটি ঠিকানায় ৪৩টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে বলে আগেই অভিযোগ উঠেছিল। এ বার সেই বিষয়ে কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র কাছে।
গত বছর সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরে পুরসভায় এই নিয়ে সরব হন কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়। শুক্রবার তিনিই ইডি-র কাছে লাইসেন্সের নথিপত্র জমা দিয়ে পুর-প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ইডি পুর-প্রশাসনের কর্তাকে ডাকতে পারে ভেবে দিনভর জল্পনা চলে পুরসভার অন্দরমহলে। তেমনটা হলে পুরসভার জবাব কী হবে, তা নিয়ে দুপুরের মধ্যেই জরুরি বৈঠক সেরে নেন লাইসেন্স দফতরের কিছু অফিসার। পরে এই বিষয়ে জরুরি কিছু কাগজপত্র মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেও পৌঁছে দেওয়া হয়। মেয়র শোভনবাবু অবশ্য বলেন, “ইডি থেকে আমাকে ডাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওই লাইসেন্স দেন সহকারী লাইসেন্স অফিসার পর্যায়ের অফিসার। প্রয়োজনে তাঁদের ডাকতে পারে ইডি। তাই কাগজপত্র ঠিক করে রাখতে বলা হয়েছে।”
৪৫৫ ডায়মন্ড হারবার রোডের ঠিকানায় সারদার বিভিন্ন সংস্থার নামে ৪৩টি লাইসেন্স দেওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসে গত বছর মে মাসে। তখনই এক ছাদের তলায় একসঙ্গে এত সংস্থার নামে লাইসেন্স দেওয়ায় অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন প্রকাশবাবু। তাঁর অভিযোগ ছিল, “সারদা গোষ্ঠীর জন্যই এই ধরনের বেআইনি কাজ করা হয়েছে।” পুর অধিবেশনেও বিষয়টি তোলেন তিনি। মেয়র শোভনবাবু সে-দিন জানান, সারদা নিয়মবিধি মেনে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। তার ভিত্তিতেই লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ১৩ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান তৃণমূল নেতা সুশান্ত ঘোষ অবশ্য তখন বলেছিলেন, ‘‘একই জায়গায় সারদার বিভিন্ন সংস্থার নামে অত লাইসেন্স দেওয়া উচিত হয়নি।”
পুরসভা সূত্রের খবর, প্রায় এক বছর আগে বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা হলেও পুর-কর্তৃপক্ষ ওই সব লাইসেন্স বাতিল করেননি। এ দিন ইডি-র এক অফিসারের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ জানান প্রকাশবাবু। তিনি বলেন, “এত বড় প্রতারণার পরেও ওঁদের লাইসেন্স বাতিল হয়নি। তার কারণ অনুসন্ধানের জন্যই ইডি-র কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে।”
তবে মেয়রের দাবি, ওই লাইসেন্সগুলো আগেই বাতিল করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাতিল হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলেননি মেয়র।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বাংলা ও ভিন্ রাজ্য মিলিয়ে সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের কয়েকশো সংস্থা ছিল। তার মধ্যে সক্রিয় ছিল ৬৫টি সংস্থা। এবং সব সংস্থারই ঠিকানা ছিল ৪৫৫ ডায়মন্ড হারবার রোড। সুদীপ্তের সব কোম্পানির আয়কর, প্রফেশনাল ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স-সহ সংশ্লিষ্ট সব কিছুই এই ঠিকানায় নথিভুক্ত। এমনকী সারদা গার্ডেন, সল্টলেকে বিলাসবহুল অফিস থাকা সত্ত্বেও সারদার যাবতীয় ব্যাপারে এই ঠিকানাই দেওয়া ছিল। সারদা সংস্থার প্রায় ১৮ হাজার কর্মী ছিলেন। সব কর্মীর নিয়োগপত্রেও এই ঠিকানাই দেওয়া হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর।
কী অবস্থায় রয়েছে ডায়মন্ড হারবার রোডে সারদার ওই অফিসটি?
বেহালায় ডায়মন্ড হারবার রোডের পাশে একটি ছোট দোতলা বাজারের সিঁড়ি দিয়ে একতলায় উঠতেই চোখে পড়ল ছোট সাদা সাইনবোর্ড। তাতে কমলা রঙের অক্ষরে লেখা ‘সারদা গ্রুপ অব কোম্পানিজ, সেকেন্ড ফ্লোর’। ওই সাইনবোর্ডের উল্টো দিকে সরু একটা সিঁড়ি তেতলায় উঠে গিয়েছে। সিঁড়িতে আলো নেই। দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলের আলো জ্বেলে কোনও রকমে সারদার অফিসের সামনে পৌঁছনো গেল।
একটি ঘরের দরজায় সাইনবোর্ডে লেখা ‘সারদা অটোমোবাইল’। অন্য একটি ঘরের দরজায় লেখা ‘সারদা রিয়েলটি’। ঘরের মেঝে ধুলো জমে কালো হয়ে গিয়েছে। ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটি মুখবন্ধ ছোট প্লাস্টিকের বস্তা। কয়েকটি পিচবোর্ডের বাক্স। শৌচাগারের দরজা ভাঙা। সাদা কোমোড ধুলোয় কালো হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দেওয়ালে আয়কর দফতরের ৩০-৪০টি নোটিস সাঁটানো। ১ বছর আগে ওই নোটিস দেওয়া হয়েছিল বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা।