কর্মচারী নেই, শনি-রবি ছুটি কাটিয়ে মরছে গ্রন্থাগার

কর্মী বাড়ন্ত। রাজ্য সরকারের কাছে বারবার কড়া নেড়েও সাড়া মেলেনি। রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলিতে বর্তমানে ৪৫ শতাংশ শূন্যপদ রয়েছে।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৫
Share:

তালাবন্ধ জাঙ্গিপাড়ার রশিদপুর ইউনিয়ন গ্রন্থাগার। ছবি: দীপঙ্কর দে।

কর্মী বাড়ন্ত। রাজ্য সরকারের কাছে বারবার কড়া নেড়েও সাড়া মেলেনি। রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলিতে বর্তমানে ৪৫ শতাংশ শূন্যপদ রয়েছে।

Advertisement

গুগল আর উইকিপিডিয়া-তাড়িত সময়ে নতুন প্রজন্মের বই বিমুখতা প্রায় সর্বজনীন। সেই বিতৃষ্ণা আর শূন্যপদের জোড়া ধাক্কায় ইতিমধ্যেই রাজ্যের ২৫৮টি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমান শাসকদের আমলে এই হাল রোজই আরও খারাপ হচ্ছে। সরকার পোষিত অধিকাংশ গ্রন্থাগারে এই মুহূর্তে কোনও গ্রন্থাগারিকই নেই।

এমনকী দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী, বিদ্যাসাগর ও মধুসূদনের স্মৃতিধন্য উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ সাধারণ গ্রন্থাগারও বেশ কয়েক বছর কর্মীর অভাবে ধুঁকছে। বহু মানুষ এখানে গবেষণার কাজ নিয়ে আসেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই গ্রন্থাগারিক-সহ বহু কর্মীর পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। নেই নিরাপত্তাকর্মীও। বিষয়টি জানিয়ে বহুবার কতৃর্পক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের টনক নড়েনি। ফলে গ্রন্থাগারের হাল দিন দিন করুণ হচ্ছে। পাঠকরা চাহিদা মতো বই পাচ্ছেন না।

Advertisement

বস্তুত এই খন্ডচিত্র শুধু উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগারের নয়, এটাই এখন রাজ্যের সার্বিক ছবি। বহু গ্রন্থাগারে কর্মীর অভাবে শুধু তালাই পড়েনি, কোথাও স্রেফ একজন নিয়ে বন্ধের দিন গুনছেন কতৃর্পক্ষ। কোথাও আবার অবসর নেওয়া একমাত্র কর্মী কেবল বিবেকের তাড়নায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে গ্রন্থাগারের দরজা খুলে রেখেছেন মাসের পর মাস। কোথাও আবার পরিস্থিতি বেশ অদ্ভুত। যেখানে কোনও সরকারি গাড়িই নেই। কিন্তু চালক বহাল রয়েছেন সেখানে। অগত্যা সেই চালক অন্য কাজ করেন। আবার কোথাও কোনও কর্মীই নেই সেখানে আবার গ্রান্থাগারের বাড়ি উঠছে। সরকার গ্রন্থাগার ভবনের জন্য টাকা অনুমোদন করেছে। অগত্যা পাশের গ্রামে একজনকে নিয়ে চলা গ্রান্থাগারের কর্মীকে উজিয়ে সেখানে আনা হচ্ছে ভবনের কাজ দেখভালের জন্য। বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে আদতে ওই কর্মী যেখানে কাজ করেন সেই গ্রন্থাগারটি।

বস্তুত বাম আমল থেকেই রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলোর গঙ্গাপ্রাপ্তির শুরু। সরকার পোষিত গ্রন্থাগারে অবসর নিয়েছেন কর্মীরা। নতুন করে আর কোনও নিয়োগ হয়নি। বহু পদ শূন্য পড়ে। কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। কাজে ভাটা পড়েছে। পাঠকেরা বই চেয়েও পান না। এর ফলেও পাঠকের সংখ্যা কমছে। বাম আমলেই কর্মীর অভাবে রাজ্যে অন্তত ৯০টি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরেও অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাজ্যে গ্রন্থাগারের সংখ্যা ২৪৬০টি। সেগুলিতে মোট পদের ৪৫ শতাংশ বর্তমানে শূন্য। যে ২৫৮টি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেগুলিতে ৫১৬টি শূন্যপদ ছিল। বঙ্গীয় সাধারণ গ্রন্থাগার ও কর্মী কল্যাণ সমিতির রাজ্য সম্পাদক রফিক শেখ বলেন, ‘‘শূন্যপদে নিয়োগের জন্য আমরা রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। সঠিক সংখ্যায় কর্মী ছাড়া গ্রন্থাগারগুলিতে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে অসুবিধা হচ্ছে।’’

পরিস্থিতিটা করুণ প্রায় সর্বত্র। বীরভূমে জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক (ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি অফিসার বা ডিএলও) নেই। বর্ধমানের ডিএলও সেখানকার দায়িত্বে। জেলায় গ্রন্থাগার ১২৪টি— গ্রামীণ ১১৪টি, শহরে ১০টি। মোট কর্মী থাকার কথা ২৭৬ জন। কিন্তু এখন ১২৩টি পদ খালি। হুগলি জেলা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারেও দীর্ঘদিন গ্রন্থাগারিক নেই। এক অবস্থা জেলার ২২টি টাউন লাইব্রেরির মধ্যে ১৭টিরও। ওই সব গ্রন্থাগারে ২২ জন সহকারী গ্রন্থাগারিক থাকার কথা। আছেন মোটে ১১ জন। জেলায় মোট গ্রন্থাগার ১৫৮টি— গ্রামীণ ১৩৫টি। এর মধ্যে ৭৭টিতে গ্রন্থাগারিক নেই। জেলায় জুনিয়র লাইব্রেরিয়ানের পদ রয়েছে ১৩৫টি। রয়েছেন মোটে ৪৫ জন। কর্মীর অভাবে চার মহকুমায় ১৬টি সরকার পোষিত গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে রয়েছে। কোথাও দরজা খোলা থাকলেও দিনরাতের রক্ষী নেই। কোথাও বুক বাইন্ডারের পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা। বর্ধমানে গ্রন্থাগারের সংখ্যা ২১২। লোকাভাবে ৩টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে মোট ২০৬টি পদ শূন্য পড়ে। বারবার চেয়েও লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

জেলার তালিকা বাড়ানো অর্থহীন। কিন্তু এই দুরবস্থার মাসুল দিতে হচ্ছে পাঠকদের। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে গবেষণার কাজ করছেন হিন্দমোটর স্টেশন লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা জয়ন্ত বসু (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বলেন, ‘‘মাস কয়েক আগে জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগারে একটি বইয়ের জন্য যাই। আমাকে বলা হল, সেটি নেই। পরে সেখানকার কর্মী আমাকে সেটি খুঁজে দেখার অনুমতি দেন। বহুক্ষণ খুঁজে দেখি, বইটি ধুলোয় তাকের পিছনে পড়ে। আর ওখানে যাই না।’’

রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী আবদুল করিম চৌধুরীর আশ্বাস, ‘‘সমস্ত গ্রন্থাগারের শূন্যপদের তালিকা তৈরি করে আমরা ইতিমধ্যেই অর্থ দফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন শূন্যপদে লোক নিয়োগ হবে। সব না হলেও আমার আশা, অন্তত কিছু পদে খুব শীঘ্রই লোক নিতে পারব।’’

তবে শুধু শূন্যপদে লোক নিয়োগ হলেই যে গ্রন্থাগার বাঁচবে, অনেকেই তা মনে করছেন না। তাঁদের মতে, ইন্টারনেটের সঙ্গে লড়ে টিকে থাকতে হলে চলতি ব্যবস্থায় অনেক রদবদল ঘটানো দরকার। সবার আগে দরকার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রন্থাগার খুলে রাখা। জয়কৃষ্ণ গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সারা সপ্তাহ সকলে স্কুল-কলেজ-অফিস নিয়ে ব্যস্ত। ও দিকে শনি-রবি লাইব্রেরি বন্ধ। সরকার ছুটির দিন বদল না করলে, মানুষ চাইলেও গ্রন্থাগারে যেতে পারবেন না। পাঠক দিন-দিন আরও কমবে।’’

রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা এমন কোনও সংস্কারের কথা ভাবছেন, তার কোনও ঈঙ্গিত অবশ্য মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন