পাঁচ বছরে পাঁচ জন কৌঁসুলি বদলেছে। বদলায়নি বকেয়ার হিসেব। রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘভাতা (ডিএ) বকেয়া রাখার ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখন দেশের শীর্ষ স্থানে। সুপ্রিম কোর্টে সরকারি কৌঁসুলিদের বকেয়া পাওনার হিসেবেও এ বার বেনজির দৃষ্টান্ত তৈরি করছে রাজ্য।
তৃণমূল জমানায় বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াইয়ে যাঁরা রাজ্যের প্রধান মুখ ছিলেন, তাঁরাই এ বার রাজ্যের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামতে চাইছেন। সকলের অভিযোগ একটাই। বছরের পর বছর রাজ্য তাঁদের পাওনা মেটাচ্ছে না। বারবার তাগাদা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এ বার কেউ আইনি নোটিস পাঠাচ্ছেন। কেউ মামলা ঠোকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ আবার আশা করছেন, অন্যরা চাপ দিলে সেই সুযোগে তাঁদের ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়বে। কিন্তু সকলের একটাই বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্যের হয়ে যে সব আইনজীবীরা কাজ করেন, তাঁদের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বারবার রাজ্য সরকারকে জোরদার আইনি যুদ্ধে নামতে হয়েছে শীর্ষ আদালতে। কখনও সারদা কেলেঙ্কারিতে, কখনও সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে। কখনও আবার পঞ্চায়েত ভোট কিংবা টেট-পরীক্ষা। একের পর এক যুদ্ধে পাল্টেছে সেনাপতিও।
মমতা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন রাজ্য সরকারের স্থায়ী কৌঁসুলি ছিলেন তারাচাঁদ শর্মা। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার পর পাঁচ বছর কাটতে চলল, এখনও তাঁর বকেয়া টাকা পাননি। তারাচাঁদবাবুকে সরিয়ে দেওয়ার পর স্ট্যান্ডিং কাউন্সেলের পদে আসেন অভিজিৎ সেনগুপ্ত। তিনি প্রায় পৌনে দু’বছর কাজ করেন। দায়িত্ব ছাড়েন ২০১২-র নভেম্বরে। রাজ্য সরকারের ঘরে তাঁরও মোটা টাকা পড়ে রয়েছে। অভিজিৎবাবুর দফতর থেকে অন্তত চার বার রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, পাওনা তো দূরের কথা। চিঠির জবাবও মেলেনি।
তারাচাঁদবাবু বলছেন, ‘‘প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা পাওনা পড়ে রয়েছে। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরে মাস তিন-চারেক আগে ৯ লক্ষ টাকা পেয়েছি। আদালতের ফি, অফিস চালাতে গেলে যে খরচা হয়, তা নিজের পকেট থেকেই দিয়েছি। সেই টাকা কবে মেটানো হবে, তা-ও জানানো হয়নি।’’ আর অভিজিৎবাবুর জবাব, ‘‘টাকা বকেয়া রয়েছে ঠিকই। কত টাকা বাকি, বলতে চাইছি না। এটা আইনজীবী ও তার মক্কেলের বিষয়। তবে মক্কেল টাকা না মেটালে তাঁর বিরুদ্ধেই মামলা করা ছাড়া
উপায় নেই।’’
অভিজিৎ সেনগুপ্ত সরে যাওয়ার পর অভিজিৎ ভট্টাচার্য মাস ছয়েকের জন্য স্থায়ী কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার পর নিয়ে আসা হয় অনীপ সাচতেকে। যিনি ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অতিরিক্ত স্থায়ী কৌঁসুলি হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৩ থেকে ২০১৫-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনীপ কাজ করেন। তার পর তাঁকেও সরিয়ে দিয়ে নিয়োগ করা হয় পারিজাত সিন্হাকে। দায়িত্ব থেকে সরার পর অনীপ সাচতেরও অবস্থা হয় পূর্বসূরিদের মতোই। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, এক কোটি টাকারও বেশি পাওনার অপেক্ষায় বসে রয়েছেন অনীপ। গত ৯ মার্চ তিনি রাজ্য সরকারকে দু’সপ্তাহের মধ্যে যাবতীয় বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। সে চিঠিরও জবাব আসেনি। বাধ্য হয়ে এখন তাই আইনি নোটিস পাঠাতে চলেছেন অনীপ। তার পর মামলার পথে যাবেন। তারাচাঁদ, অনীপ, দু’জনেই বলছেন, কলকাতাতেও তাঁদের যে সব বন্ধু আইনজীবী রাজ্যের হয়ে মামলা লড়েন, তাঁরাও সময়ে টাকা পান না। হাইকোর্টে পিটিশন করে বকেয়া টাকা আদায় করতে হয় তাঁদের। তারাচাঁদবাবু বলেন, ‘‘বাকিরা মামলা করলে তার চাপে আমার টাকাও মিটিয়ে দেওয়া হবে, এই আশাতেই রয়েছি।’’
কী বলছে রাজ্য সরকার?
রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কোন আইনজীবীর কত টাকা পাওনা রয়েছে, সে বিষয়ে আমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কোনও আলোচনা করব না।’’
রাজ্যের আইন দফতর সূত্রের বক্তব্য, এটা ঘটনা যে, রাজকোষে এমনিতেই টাকা নেই। যে কারণে সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘভাতা ৫০ শতাংশ
ছাড়িয়েছে। কিন্তু মেলা-খেলা-উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ হলে আইনজীবীদের কয়েক কোটি টাকা মেটাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্থায়ী কৌঁসুলিরা যত দিন দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের টাকা খেপে-খেপে দেওয়া হচ্ছিল। আসল সমস্যা অন্যত্র। দায়িত্ব থেকে সরানোর পরই সব পাওনা মেটানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অপসারিত কৌঁসুলিদের উপরে সরকারের শীর্ষমহল ক্ষুব্ধ বলেই আইন দফতরে বার্তা পৌঁছেছে। তাঁদের বকেয়া মেটানোর উদ্যোগ নিয়ে কেউ আর ‘উপরমহলের কোপে’ পড়তে চাননি।
কিন্তু এতে যে শীর্ষ আদালতে আইনজীবী মহলে রাজ্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে— তা-ও মানছেন আইন দফতরের কর্তারা। তাঁদের মতে, কোনও রাজ্যের স্থায়ী কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করতে হলে অন্য কোনও মামলা হাতে নেওয়া যায় না। শুধু অফিস চালাতে গেলেই মাসে অন্তত দেড় লক্ষ টাকা খরচ হয়। সারদার মতো মামলায় সওয়াল করার জন্য বাঘা বাঘা আইনজীবীদের নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁদের অর্থ কিন্তু মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁরা স্থায়ী কৌঁসুলি, যাঁদের হাতে মামলা পরিচালনার ভার, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের তরফে যিনি দায়বদ্ধ, তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে কেউ এই দায়িত্ব নিতে দু’বার ভাববেন।