বিমান বসুর সঙ্গে করমর্দন রেজ্জাক মোল্লার। পাশে রয়েছেন গৌতম দেব। শনিবার হুগলির ফুরফুরা শরিফে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে। ছবি: দীপঙ্কর দে।
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যত কাছাকাছি আসছে, সংখ্যালঘুদের মন জয়ে দৌড়ের গতি তত বাড়াচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। গত ৭-৮ বছর ধরে সংখ্যালঘুদের কাছে টানার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করতে দেখা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর সরকারি স্তরে নানা সিদ্ধান্তকেও তিনি সংখ্যালঘুদের বার্তা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছেন। এখন বিধানসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যই বিরোধীরাও কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এই দৌড়ে কমিউনিস্ট বিমান বসু থেকে তৃণমূলের অধুনা ব্রাত্য সেনাপতি মুকুল রায়— কেউ বাদ নেই!
তৃণমূলে মুকুলের ইনিংস এখন প্রায় অতীত। তার নতুন দল বা মঞ্চ গড়া নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। এই পর্বে মুকুল মনোযোগ দিয়েছেন মমতার সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের দিকেই। এক দিকে যেমন তিনি ফুরফুরা শরিফে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, তেমনই তাঁর নিজের ডেরা নিজাম প্যালেসে সম্প্রতি ইফতার আসর আয়োজন করে তৃণমূলে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছেন। গোটা পরিস্থিতি আঁচ করে পিছিয়ে থাকছে না বামেরাও। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব শনিবারই গিয়েছিলেন ফুরফুরা শরিফে। সেখানে গিয়ে বিমানবাবুরা প্রত্যাশিত ভাবেই সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবে তার রূপায়ণের করুণ হাল নিয়ে সরব হয়েছেন। ফুরফুরা শরিফে গিয়ে এ দিন বিমানবাবু বলেন, ‘‘চার বছরের রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে নানা কথা বলেছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। ফুরফুরা শরিফে রেল প্রকল্প পৌঁছয়নি। ডানকুনিতে আইটিআই হয়নি।’’
ফুরফুরা শরিফে বামেদের যাওয়া নিয়ে তৃণমূলের মুখ্য জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ ব্রায়েনের তির্যক মন্তব্য, ‘‘নিশ্চয়ই ওঁরা নতুন কিছু শিখছেন।’’
বিমানবাবু বা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য এর আগেও ফুরফুরা শরিফে যেতেন। বামফ্রন্টের প্রবীণতম নেতা অশোক ঘোষ বহু বছর ধরেই তাঁর দলের দফতরে ইফতার আসর আয়োজন করে আসছেন। আজ, রবিবারই তাঁর সেই বাৎসরিক ইফতারের আয়োজন হয়েছে। সংখ্যালঘুদের মন পেতে এ বারের এই বাড়তি তৎপরতা কেন? রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, বছর দেড়েক ধরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণই এই তৎপরতার নেপথ্য কারণ। গত লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। উল্টো দিকে, লোকসভা এবং তার পরের কিছু উপনির্বাচনে সংখ্যালঘুদের সিংহভাগ ভোট ঘরে তুলেছে তৃণমূল। যদিও বিগত পুরসভার ভোটে তৃণমূলের বিপুল ‘সাফল্য’-এর মধ্যেও তাদের সংখ্যালঘু আমানতে কিছু টান পড়ার চিহ্ন দেখা গিয়েছে। পাশাপাশি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন। এই অবস্থায় বাম, কংগ্রেস এবং মুকুলবাবুরা চেষ্টা করছেন সংখ্যালঘুদের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে আরও ভাঙন ধরাতে। এক দিকে বিজেপি-র বিপদ এবং অন্য দিকে তার প্রতিশ্রুতিভঙ্গ— এই দুটোকেই জোড়া হাতিয়ার করতে চাইছেন তাঁরা।
সংখ্যালঘুদের বার্তা পাঠাতে বাড়তি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস শিবিরেও। দলের সংখ্যালঘু সেলের তরফে খালেদ ইবাদুল্লা নানা
জেলায় ইফতারের আয়োজন করেছেন। অন্য বার কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের ইফতার সংখ্যালঘু শাখাই করে থাকে। এ বার বহু বছর বাদে স্বয়ং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বিধান ভবনেই ইফতারের আয়োজন করছেন। সনিয়া গাঁধীর ডাকে সোমবার দিল্লিতে অধীর-খালেদরা ইফতারে হাজিরা দিয়ে
এসে মঙ্গলবার নিজেরাই আবার সেই আসর বসাবেন।
এমতাবস্থায় তৃণমূল শিবির তাদের সংখ্যালঘু নেতা এবং নানা সংগঠনকে কাজে লাগাচ্ছে। কলকাতা পুরসভার বাৎসরিক ইফতারে ইতিমধ্যেই হাজির হয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এর পরে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের একটি ইফতার আসরেও তাঁর যাওয়ার কথা। বিরোধীদের তৎপরতাকে বিঁধে শাসক দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘বাংলার সংখ্যালঘুরা জানেন, তাঁদের বন্ধু এবং ভরসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।’’