মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
‘‘আগামী ২৭ জুলাই থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হবে। দোকানে গিয়ে বলছে, মাছ খাবেন না, মাংস খাবেন না। দোকানে গিয়ে ভাঙচুর করছে। এখানে করে দেখো। বাংলায় এক বার করে দেখাও, সাহস দেখি। বেশি করে বাংলা বলুন। কোনও ভাষার উপরে আক্রমণ মানব না। আগামী নির্বাচনের রেজ়াল্ট বেরোনো পর্যন্ত চলবে আন্দোলন।’’
‘‘এখান থেকেই বলেছিলাম বদলা নয়, বদল চাই। এ বার বলছি, ‘জব্দ হবে, স্তব্ধ হবে।’ আমাদের দর্শন, তোমাদের বিসর্জন। বাকিটা নির্বাচনের সময় বুঝিয়ে বলব।’’
মমতা বলেন, ‘‘২৭ জুলাই নানুর দিবস থেকে প্রতি শনি ও রবিবার বাংলা ভাষার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে মিটিং-মিছিল করুন। প্রতিবাদে নামুন। এ বার শুরু হল ভাষারক্ষার শপথ। ’’
মমতা বলেন, ‘‘দলের সম্পদ কর্মীরা। আমার দলের সম্পদ বাংলার মা-মাটি-মানুষ। যখন তৃণমূল জন্ম নিয়েছিল, বলেছিল ঘাস গরুতে খেয়ে নেবে। এখন তৃণমূল বটবৃক্ষ। যাঁরা ভাবছেন মমতা-অভিষেককে গালাগালি দিয়ে তৃণমূলকে গুঁড়িয়ে দেবেন, বড় ভুল করছেন। কী ভেবেছ? ইডি-সিবিআই দিয়ে শেষ করবেন? চ্যালেঞ্জ রইল। ড্যামেজ ম্যানেজ করা যায় না। কত জনকে জেলে জায়গা দেবেন?
মঞ্চে মমতা-অভিষেক পাশাপাশি। —নিজস্ব চিত্র।
মমতার দাবি, বাংলায় একের পর এক উন্নয়নে ভয় পেয়ে বঞ্চনার রাজনীতি করছে বিজেপি। বাংলা জুড়ে কাজ হয়েছে। তাই বাংলাকে নিশানা করছে বিজেপি। মমতা বলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উপর সন্ত্রাস চলছে কেন? বাংলা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। নবজাগরণ হয়েছে বাংলা থেকেই। বাংলার মাটি দুর্বৃত্তদের হবে না। বাংলার মানুষকে যদি বাংলা বলার জন্য বাইরে গ্রেফতার করা হয় এই লড়াই কিন্তু দিল্লিতে হবে। আমি কিন্তু ছাড়ার লোক নেই। মনে আছে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কথা?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘দরকারে আবার ভাষা আন্দোলন শুরু হবে।’’
বিজেপিকে নিশানা করে মমতা বলেন, ‘‘বাংলায় কথা বলতে ভয় পান আপনারা। বাংলা রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুলের জন্ম দিয়েছে। বাংলা থেকেই লেখা হয়েছে,জাতীয় সঙ্গীত।’’
মমতার সংযোজন, ‘‘মতুয়া ভাইদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। কী জবাব দেবে তার বিজেপি? যখন ওড়িশায় ছাত্রীর সম্মান নষ্ট হল, যখন ওড়িশার রাস্তায় ছাত্রীর গায়ে আগুন ধরানো হয়, তার উত্তর কে দেবে? উত্তর দিতে হবে।’’
‘‘বাংলা ভাষায় নাকি কথা বলা যাবে না! কে মাছ খাবে, কে মাংস খাবে, কে ডিম খাবে ওরা ঠিক করে দেবে! বিজেপির এক জন নেতা বলছেন এখানে নাকি ১৭ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে। মোট কত রোহিঙ্গা? আপনি এত জনকে বাংলাতেই বা পেলেন কোথায়?’’
মমতা বলেন, ‘‘বিজেপির চক্রান্ত তো চলছে। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে। মানুষের কথা বলে না তারা। নির্বাচনের আগে প্রথম সার্কুলার ভারত সরকার পাঠিয়েছে। এক হাজারের উপর লোককে কাউকে মধ্যপ্রদেশ, কাউকে ওড়িশা, তো কাউকে রাজস্থানের জেলে ভরা হয়েছে।’’
মমতার দাবি, কেন্দ্রের বঞ্চনা সত্ত্বেও তাঁর সরকার বাংলার মানুষের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক জনহিতকর প্রকল্প রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আবাস প্রকল্পে গরিবদের বাড়ি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মস্থানের উন্নতিকল্পে কাজ করেছে তৃণমূল সরকার। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।
মমতা বলেন, ‘‘এই সংগ্রাম চলবে, সে দিন শেষ হবে যে দিন দিল্লিতে পরিবর্তন হবে। আর বামেদের কথা ছেড়ে দিন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে টাকা খেয়ে বসে আছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা এখানে ৪০ শতাংশ বেকারত্ব কমিয়েছি। এটা বাংলার মানুষের গর্ব। আপনারা ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দিয়ে কী ভেবেছিলেন? বাংলা করতে পারে না? আমরা পেরেছি।’’
মমতা বলেন, ‘‘আমি সম্মান জানাই সমস্ত শহিদের পরিবারকে। ঝন্টু আলি শেখের বাবা সবুজ আলি শেখ এসেছেন। বিতান অধিকারীর বাবা বীরেশ্বর অধিকারী ও মা মায়া অধিকারী এসেছেন। তাঁদের সম্মান জানাই।’’
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান ২৬ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলার তিন জন। পাটুলির বাসিন্দা, কর্মসূত্রে বিদেশে থাকা বিতান অধিকারীকে খুন করে জঙ্গিরা। মারা যান পুরুলিয়ার বাসিন্দা মণীশরঞ্জন মিশ্র এবং বেহালার সমীর গুহ। সেই বিতান অধিকারীর বাবা-মাকে দেখা গেল ধর্মতলার মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে গিয়ে বসান। অন্য দিকে, নদিয়ার তেহট্টের পাথরঘাটার বাসিন্দা ছিলেন ঝন্টু আলি শেখ। জঙ্গি হামলার পর উধমপুরে তল্লাশি চালাতে গিয়ে গুলির লড়াইয়ে মৃত্যু হয় ৩৬ বছরের ওই জওয়ানের। তাঁর বাবা এসেছেন ধর্মতলায় তৃণমূলের মঞ্চে।
২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে সাধারণত দলকে আগামিদিনের দিক্নির্দেশ দেন মমতা। তাই বিধানসভা ভোটের আগে এ বারের ‘শহিদ মঞ্চ’ থেকে তিনি কী বার্তা দেন, সে দিকে নজর সকলের।
রাজ্যের বিরোধী দল থেকে বাংলায় ক্ষমতা দখল— ২১ জুলাই দেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূলের নানাবিধ উত্থান-পতন। রয়েছে নাটকীয় কিছু ঘটনা, আছে বিতর্ক। বিগত দু’দশক ধরে ২১ জুলাই তারিখটি তৃণমূলের কাছে অঘোষিত বার্ষিক রাজনৈতিক সমাবেশ। ২০১১ সালের ১৩ মে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছিল। ৩৪ বছরের বাম শাসনের পালাবদল ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল। তবে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁরা আলাদা করে ‘বিজয় উৎসব’ পালন করবেন না। জয়ের উদ্যাপন হবে ২১ জুলাই ‘শহিদ তর্পণের’ দিন। আবার গত লোকসভা ভোটে বাংলায় ২৯টি আসন জেতার পর মমতা জানান, উদ্যাপন করা হবে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। তখনও জন্ম হয়নি তৃণমূলের। যুব কংগ্রেসের ডাকে মহাকরণ অভিযানের নেতৃত্ব ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের ক্ষমতায় বাম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সিপিএমের বিরুদ্ধে ভোটে রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে মহাকরণ অভিযান করে যুব কংগ্রেস। রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক সচিবালয়ের উদ্দেশে ওই অভিযান রুখতে তৎপর হয় কলকাতা পুলিশ। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ব্যারিকেড তৈরি হয়। ক্রমশ উত্তপ্ত হয় পরিস্থিতি। চলে গুলি। নিহত হন ১৩ জন যুব কংগ্রেসের নেতা-কর্মী। যার প্রেক্ষিতে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। কার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালাল, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। ওই সময় রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরবর্তী কালে এই মামলায় বুদ্ধদেবকে ক্নিনচিট দেয় সিবিআই।