—ফাইল চিত্র।
ভোট এলে একটু ভয়ে থাকি। অন্তত ভোটের আগের কয়েক মাস তো বটেই। অনেকে বলবেন, এ আর নতুন কথা কী! আমরা সবাই তো ভয়ে থাকি। পার্টিতে পার্টিতে সন্ত্রাস। ফলস্বরূপ চোরাগোপ্তা খুন, রক্তপাত। বিরোধিতা কিংবা সমর্থনের উল্লাস মিছিল, গলি কিংবা রাজপথে প্রাত্যহিকের চেনা ছন্দকে টলমল করে দিশাহীন এক দূরন্ত ঘূর্ণির পাকে পাকে বন বন করে খানিকটা ঘুরিয়েও মারে। আমরা গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় উৎসবে তাই কখনও লাট্টু, কখনও লেত্তি। তাই এই নির্দিষ্ট সময়কালে এক জন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গী যেমন ‘ভয়’, তেমনই ভরসা হল ‘ভোট’।
আসলে আমি বলতে চাইছিলাম অন্য এক ভয়ের কথা। যে ‘ভয়’ একমাত্র আমার। নিজস্ব, ব্যক্তিগত। এক জন ডাক্তার, মোক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, কেরানি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক, মুটে, মজুর— কেউই হয়তো ঠিক এই ভয়ের চেহারাটা আন্দাজ করতে পারবেন না। পারবেন না কারণ, আপনারা কেউই তো ‘নাটক’ করেন না। কিন্তু আমি যে ‘নাটক’ করি। প্রায় প্রতিদিন। আমি যে নাট্য শিল্পী। অভিনেতা। ওটাই আমার পরিচয়। অস্তিত্ব।
এই ভোট মরশুমে পথসভা থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনীতির নেতা যখন এক পর্দা, দুই পর্দা থেকে বাড়তে বাড়তে তারসপ্তকে গলা তুলে বক্তব্যটিকে হাততালির সমে এনে ফেলেন, তখন পথ চলতি মানুষ আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, ওহে অভিনেতা, দেখে শেখ, ‘অ্যাক্টিং’ কাকে বলে! কখনও সখনও মৃদু প্রতিবাদ করে বলেছি, ‘‘উনি তো বক্তৃতা দিচ্ছেন, আপনি ‘অ্যাক্টিং’ বলছেন কেন? অভিনয় মানে তো...’’। মুখের উপর উত্তর পেয়েছি— ‘‘এটা অ্যাক্টিং নয়!’’ যা হওয়ার নয়, যা কোনও দিন হবে না, যা হতে পারে না, যাতে বক্তার নিজেরই কোনও বিশ্বাস নেই, সেই সংলাপগুলোকে কেমন আমাদের গিলিয়ে, বিশ্বাস করিয়ে হাততালি নিচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন না? স্টেজে আপনি তো তা-ই করেন। মিথ্যার মায়া তৈরি করে মজিয়ে দেন দর্শকদের।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তার মানে ‘মিথ্যা’র প্রতিশব্দ হয়ে উঠল ‘নাটক’। হ্যাঁ, আমরা যা নই, তা সাজি বটে। মুখে রং মেখে জরির পোশাক পরে বানানো সংলাপ আউড়ে তৈরি করি এক মঞ্চ মায়া। সেই বানানো কথা, সেই বানিয়ে তোলা ঘর-বাড়ি, বারান্দা, সেই ফুট লাইটের মায়াবি আলো-অন্ধকারের কাল্পনিক সংসারে আমরা তো শেষমেশ প্রতিষ্ঠা দিতে চাই একটি সত্যের। যে সত্যের সঙ্গে দর্শক নিজের অবস্থানকে মিলিয়ে দেখবেন। তার পর হয় এই ধারণাটিকে গ্রহণ করবেন, নয়তো বর্জন করবেন।
অর্থাৎ, তথাকথিত ‘মিথ্যা’কে ধরে আসলে এক অমোঘ সত্যের কাছে পৌঁছনো। কিন্তু উঠতে বসতে এই ভোট আবহে ‘নাটক করো না’, ‘নৌটঙ্কি’, ‘ড্রামাবাজি’ শব্দগুলি যখন বার বার ফিরে আসতে থাকে, আর পাত্রপাত্রী হিসেবে দেশের শাসক অথবা বিরোধী পক্ষের নেতা নেত্রীদের মুখগুলি ভেসে ভেসে ওঠে, তখন আমার মতো নাটক করিয়ে তার অস্তিত্বের সঙ্কটে ভোগে। ভয় করে। এ আমার নিজস্ব পরিচয়ের ভয়। মাঝে মাঝে ভাবতে বসি, সব ছেড়ে ভোট বাজারে এই ‘নাটক’ শব্দটি এত ফিরে ফিরে আসে কেন?
একটু পেছনে তাকানো যাক। প্রাচীন এথেন্সে এক জন গ্রিক অভিনেতা নির্দেশক ছিলেন। যার নাম ‘থেসপিস’। শোনা যায়, তাঁর নাকি খানিক দৈব জ্ঞানও ছিল। তাঁর অভিনয় প্রতিভায় সমগ্র এথেন্স মুগ্ধ। একদিন পণ্ডিত সোলোন, যে বুড়ো ক্ষমতারই এক প্রতিনিধি, ‘থেসপিস’এর নাটক দেখতে এলো। সে দিন অভিনেতা ‘থেসপিস’ রাজা জিউসের ভূমিকায়। সেই অভিনয়ের সত্য অভিঘাত বুড়ো সোলোনের মনে ভয় ধরিয়ে দিল। এই ‘থেসপিস’ মঞ্চের উপর এমন কিছু করে, মনে হয় ওই জিউস। ওই রাজা, ওই ক্ষমতা। ওই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। ও বদলে দিতে পারে রাজাকেও।
অতএব ওকে বিশ্বাস করা যাবে না। ও ভয়ানক। আজকের আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রনায়কেরা তাই অনেক অস্ত্রের মতোই ‘অভিনয়’কে অন্যের হাতে না রেখে নিজের ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। ভাবলেন, আমিই একটু উঁচু জায়গা থেকে তৈরি করব সেই মঞ্চ মায়া, যাতে আমাকেই মনে হবে ভগবান। রাজা, জিউস। শুধু তা-ই নয়, কখনও কখনও পরিচয় পাল্টে হয়ে যাব তোমার সখা, বন্ধু, মা, বাবা, শিক্ষক কিংবা চৌকিদার। প্রয়োজনে মঞ্চের ঘেরাটোপ থেকে নেমে এসে তোমার বাড়ির দাওয়ায় পাত পেড়ে খাব। তোমার ঘরের গরমে তোমারই সঙ্গে ঘেমে নেয়ে আমজনতাকে দেখিয়ে দেব ‘আমজনতা’ হওয়া কাকে বলে। কী ভাবে সাজতে হয়। সাজাতে হয়। শুধু সংলাপ বা বাচিক অভিনয় নয়, প্রয়োগ করব শরীরি ভাষা, যাকে বলে ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’। পরম মমতায় হাতে তুলে নেব সাফাই কর্মীর পা। নিজের হাতে ধুইয়ে দেব। প্রমাণ করব আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় সেই ছবি দেখে আমার দিকে আঙুল তুলে কেউ কেউ বলবেন— ‘‘দেখ, চোখ দু’টো দেখ। আহা! কী এক্সপ্রেশন; দেখে শেখো।’’ ভয়টা সেখানেই। এ এক ব্যক্তিগত অপমান।
আমরা জানি, এ জগৎ এক নাট্যশালা। সেই জগতের মাটির দখল নেওয়া হলে এই ভোটের আগমনীতে ইচ্ছে তো হয় ‘আকাশে’র দখলদারিরও। সেই অন্তরীক্ষের জমি দখলের খেলায় ছক্কা হাঁকিয়ে কে না উৎসব করতে চায়? সেই ডায়লগ, সেই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তো একটু উচ্চকিত হবেই। একটু যাকে বলে লার্জার দ্যান লাইফ। এই অবধি ঠিকই আছে। কিন্তু নাটকীয় সংলাপ নিয়ে যখন বিরোধী নেতা মঞ্চে অবতীর্ণ হন, দাঁত চেপে বলেন— ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’, বিপত্তি হয় তখনই। এই রঙিন দখলদারির ফানুসটাকে ফাটাবার জন্য হাতে পেয়ে যান ২৭ মার্চ— অর্থাৎ বিশ্ব নাট্য দিবসকে। শাসক দলের সর্বোচ্চ নেতার প্রতি বিরোধী দলের সর্বাধিনায়ক শ্লেষে, উল্লাসে অথবা আমোদে ঘটনাটিকে বিশ্ব নাট্য দিবসের শুভেচ্ছা অথবা প্রাপ্তি বলে তুলে ধরেন। যাকে বলে ‘মাস্টার স্ট্রোক’। অতএব এই বিশেষ দিনটি, নাট্যকর্মীদের নিজস্ব এই দিনটিও মিথ্যার প্রতিশব্দ উদ্যাপনের দিন হয়ে উঠল। চুরি হয়ে গেল আমার পরিচয়, অস্তিত্ব, অস্তিত্বের আকার। ভয়টা এখানেই।
ভয় থেকেই কি তৈরি হয় এক ধরনের সাহস? পৃথিবীর নাটকের ইতিহাসে এক বর্ণময় যোদ্ধা নাট্যকার নির্দেশক বার্টোল্ট ব্রেখট তখন পূর্ব জার্মানিতে। ১৯৫৩ সালের ‘ফুড রায়টে’র সময় সেখানে শ্রমিকেরা দাবি জানাচ্ছিলেন— এই শাসক-মণ্ডলী বাতিল করো। অন্য শাসকদের আমরাই নির্বাচিত করব। ব্রেখট একটা ছোট্ট কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এদের বাতিল করার দরকার কী? তার চেয়ে বরং এই জনগণকেই বাতিল করে দেওয়া যাক। সেটাই হবে সহজ।’ ভোটের মুখে নাটকের এই নানারকম ব্যবহার মনে করালো এই নাটকীয় কবিতাটিকে। ‘নাট্য’ বা ‘নাটক’ বা ‘ড্রামা’ বা ‘প্লে’ কিন্তু আজও সত্যকে ছুঁয়ে আছে। তার নিজস্ব ব্যক্তিগত অনুভবের সত্যকে। মিথ্যার বা মায়ার সিঁড়ি বেয়ে সত্যের তীর্থক্ষেত্রে আজও সে পৌঁছতে চায়। অনেক সময় পারেও। তাই ব্রেখট নামের এক নাট্যকার লিখেছিলেন এক ‘অসম্ভবের গান’। যা এক দিন হয়তো সত্য হবে, এই আশায় —‘ফুটপাত থেকে এসে ভিখিরির ছেলেটা মখমল মোড়া এক সিংহাসনে বসবে/ যার যা ইচ্ছা নিয়ে যাও, নিয়ে যাও বলে হো হো হাসবে/ সেই স্বপ্নের দিনও, গল্পের দিনও, অদ্ভুত দিনও আসবে’।
আপাতত ভোট আসছে। অতএব...। একটু ‘নাটক’ হয়ে যাক।