১৮৮ বছর পরে বন্ধ মন্দিরের দরজা

সংস্কার নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের

একশো অষ্টআশি বছরের মাথায় বন্ধ করা হল সিংহদুয়ার। ১৮২৮ সালে নির্মাণ হওয়ার পর থেকে এই প্রথম নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের সিংহদরজা বন্ধ করা হল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০০:৪৪
Share:

মহাপ্রভু মন্দিরের এখন এমনই হাল। —নিজস্ব চিত্র।

একশো অষ্টআশি বছরের মাথায় বন্ধ করা হল সিংহদুয়ার। ১৮২৮ সালে নির্মাণ হওয়ার পর থেকে এই প্রথম নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের সিংহদরজা বন্ধ করা হল। ১৮২৮ থেকে ২০১৬, প্রায় দু’শো বছরের পুরানো ওই মন্দিরের আমূল সংস্কারের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে ৭ জুলাই। তার পর থেকে মন্দিরের দরজা বন্ধ করার কথা জানিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

নবদ্বীপের এই মন্দিরেই নিত্য পূজিত হন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভুর মূর্তি। কথিত রয়েছে, যে মূর্তি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নির্মাণ করান চৈতন্যদেবের জীবিত কালেই। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে, বিরহকাতর বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের একটি মূর্তি নির্মাণ করান। সেই বিগ্রহের সেবাপুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটান। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয় যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান, বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। সারা বিশ্বের বৈষ্ণবভক্ত নবদ্বীপে ছুটে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানে।

বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী জীবিত কালে ওই বিগ্রহের পুজোর জন্য বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে কালো পাথরের মন্দির নির্মাণ করান। কালের গ্রাসে সে মন্দির গঙ্গা গর্ভে চলে যায়।

Advertisement

নবদ্বীপের বর্তমান মহাপ্রভু মন্দিরের ইতিহাস প্রসঙ্গে গোস্বামী বংশজাত অধ্যাপক প্রদ্যোতকুমার গোস্বামী তাঁর “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখছেন, “১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন মহাপ্রভুর মধ্যাহ্ন ভোগের পর মহাপ্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী অপ্রকট হলেন।” ওই বই অনুসারে বিগ্রহের সেবাপুজোর দায়িত্ব পেলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মাধবাচার্য। তাঁর মৃত্যুর পর পুজোর দায়িত্ব বর্তায় জ্যেষ্ঠপুত্র ষষ্ঠীদাসের উপর। এই সময় থেকেই সমস্যা শুরু হল। নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজ মহাপ্রভুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করেন। শক্তির উপাসকেরা মহাপ্রভু মূর্তি পুজোর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। এমনকি তৎকালীন নদিয়ারাজের কাছে অভিযোগ জানান। এই অবস্থায় অন্য ভায়েরা মহাপ্রভুর মূর্তি পুজোর অধিকার ত্যাগ করলে ষষ্ঠীদাস মালঞ্চপাড়ায় একটি পর্ণকুটিরে গোপনে ওই মহাপ্রভু মূর্তির সেবা পুজোর ব্যবস্থা করেন। “নবদ্বীপের সমাজ এবং সংস্কৃতি” বই অনুসারে, মহাপ্রভুকে পুজো করার অপরাধে গোস্বামীরা সমাজচ্যুত হলেন। তখন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার এবং মহাপ্রভু মূর্তি রক্ষার তাগিদে দক্ষিণা কালিকার মূর্তিস্থাপন করে পুজো করতে লাগলেন। কালী মন্দিরের নীচে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে ঘিয়ের প্রদীপ দিয়ে মহাপ্রভুর সেবা পুজো করতে লাগলেন কোনও রকমে।”

কিন্তু সে সময়ে মালঞ্চপাড়া ভাগীরথীর জমা জলে বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলাকীর্ণ হয়ে থাকত। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে পরম বৈষ্ণব দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ তোতারাম দাস বাবাজীর তৎপরতায় তৈরি হয় একটি পশ্চিমদ্বারী মন্দির। সেখানেই শুরু হয় মহাপ্রভু বিগ্রহের সেবা পুজো। কিন্তু এই মন্দির আয়তনে ছিল অত্যন্ত ছোট। অবশেষে ১৮২৮ সালে ভাগ্যকুলের জমিদার গুরুপ্রসাদ রায়ের অর্থানুকূল্যে ওই পশ্চিমদ্বারী মন্দিরের পাশেই গড়ে ওঠে বর্তমানের দক্ষিণদ্বারী মন্দিরটি। শুক্রবার থেকে সেই মন্দিরটির আমূল সংস্কারের কাজ শুরু হচ্ছে।

কী ধরনের সংস্কার হবে মন্দিরের? উত্তরে মন্দিরের পরিচালক শ্রীশ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির তরফে সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, “সব মিলিয়ে দু’টি পর্বে আমূল সংস্কার করা হবে নাটমন্দির এবং গর্ভগৃহের। তৈরি করা হবে একটি নতুন অতিথি আবাস। তবে সিংহদরজা সংস্কারের কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।” সমিতির তরফে সুদিন গোস্বামী বলেন, “আমরা মন্দিরের সব কিছু সংস্কারের কাজে হাত দিচ্ছি না। কেননা এই মন্দিরের আদি পশ্চিমদ্বারী মন্দিরের অংশটি নিয়ে ইতিমধ্যে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে সার্ভে করা হয়েছে। ওঁদের পরামর্শ মতোই মন্দিরের বাকি অংশের সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।” সমিতির তরফে পুলক গোস্বামী বলেন, “প্রথম পর্বে নাটমন্দির সহ অন্য বাইরের অংশ। পৌষমাসে বিগ্রহের অঙ্গরাগের সময় হবে গর্ভগৃহ সংস্কারের কাজ।”

নবদ্বীপের প্রাচীন মহাপ্রভু মন্দির সংস্কারের জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে একটি সার্ভে করা হয়েছে। জুনের মাঝামাঝি হওয়া ওই সার্ভের দায়িত্বে ছিলেন সংস্থার ডেপুটি সুপারিনন্টেন্ডিং আর্কিওলজিস্ট বিমল সিংহ। মন্দিরের সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নবদ্বীপের প্রাচীন মহাপ্রভু মন্দিরের সংস্কারের জন্য সম্প্রতি একটি বিশেষ সার্ভে করা হয়েছে। সেই সার্ভে রিপোর্ট দিল্লিতে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত পাওয়া যাবে।” এখন মন্দিরের যে অংশে সংস্কারের কাজ হচ্ছে, তাতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কোনও আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন বিমল সিংহ।

বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির তত্ত্বাবধানে যে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে তার আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা বলে জানান সুদিনবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন