(বাঁ দিকে) হুমায়ুন কবীর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ঘটনা ১: বুধবার মালদহ থেকে বহরমপুরে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, ৩২ হাজার চাকরি বহাল রাখা নিয়ে হাই কোর্টের রায়ের প্রতিক্রিয়া জানানো। কিন্তু তার মধ্যেই হুমায়ুন কবীরকে নিয়ে প্রশ্ন করায় দৃশ্যতই বিরক্ত হয়েছিলেন মমতা।
ঘটনা ২: বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতার নির্দেশেই সাংবাদিক বৈঠক করে ফিরহাদ হাকিম (ববি) ঘোষণা করেন, হুমায়ুনকে সাসপেন্ড করা হল। তখন হুমায়ুন হাজির বহরমপুরে মমতার সভাস্থলে। তাঁকে সাসপেন্ড করার খবর পেয়েই সভাস্থল ছাড়েন তিনি।
ঘটনা ৩: বৃহস্পতিবার দুপুরে বহরমপুরের মঞ্চে বক্তৃতা করতে উঠে নাম না-করে ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুনকে বিঁধলেন মমতা। বার্তা দিলেন, ‘বিজেপির তাঁবেদার’ হইতে সাবধান!
মাস দেড়েক আগেই ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, তিনি নতুন দল গড়ে ২০২৬ সালের ভোটে লড়বেন। এ-ও ঘোষণা করেছে যে, বাবরি মসজিদের আদলে মসজিদ গ়ড়বেন। শনিবার, ৬ ডিসেম্বর সেই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কর্মসূচি আছে তাঁর। সকাল-বিকাল নিয়ম করে প্রতিদিন তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তথা কান্দির বিধায়ক অপূর্ব সরকারকে (ডেভিড) নিশানা করছিলেন হুমায়ুন। কিন্তু এত দিন তাঁকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিল না তৃণমূল। বৃহস্পতিবার মমতার সভার ঠিক আগে কেন তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হল?
আনুষ্ঠানিক ভাবে এ বিষয়ে তৃণমূলের কেউ কিছু বলছেন না। কিন্তু দলের অন্দরের খবর, ‘সময়’ বুঝে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমত, মমতা জেলায় থাকাকালীন হুমায়ুনের শাস্তি ঘোষণা করা হল। তৃণমূল সূত্রের খবর, বুধবার রাতেই হুমায়ুনের শাস্তি ঘোষণার বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন মমতা। সাংবাদিক বৈঠকের দায়িত্ব দেন ববিকে। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ডেকে নেওয়া হয় রাজ্যের মন্ত্রী আখরুজ্জামান এবং হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখকে। এঁদের মধ্যে নিয়ামত আবার হুমায়ুনের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। ববির সঙ্গে তাঁরাও ছিলেন সাংবাদিক বৈঠকে। দ্বিতীয়ত, বাবরির নাম নিয়ে মসজিদ উদ্বোধনের মধ্যে খোলামেলা ‘ধর্মীয় সুড়সুড়ি’ রয়েছে বলে মনে করে তৃণমূল। তাই ৬ ডিসেম্বর হুমায়ুনের কর্মসূচির আগেই তাঁকে শাস্তি দিল দল। যাতে সেই কর্মসূচির সময়ে তাঁর গায়ে তৃণমূল বিধায়কের ছাপ না-থাকে।
তৃণমূলের অন্দরে একাংশের বক্তব্য, হুমায়ুন বিজেপি-র এক ‘প্রভাবশালী’ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সেই নেতার ‘সাহায্য’ নিয়েই তিনি নতুন দল গড়ে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে উদ্যোগী হবেন। হুমায়ুনের আগে বিজেপি-তে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ফলে যে ‘খবর’ নিয়ে আলোচনা চলছে, তা একেবারে অবিশ্বাসযোগ্যও নয়। সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে মমতা তথা তৃণমূল আগাগোড়াই ‘স্পর্শকাতর’। ফলে ‘বিজেপি-র তাঁবেদার’কে শাস্তি না দিয়ে মমতার উপায় ছিল না। বহরমপুরের সভা থেকে মমতা হুমায়ুনের নাম না-করে বলেছেন, ‘‘ভোটের আগে অনেকে ব্ল্যাকমেল করে। বিজেপির টাকা খেয়ে তাঁবেদারি করে। তাদের বিশ্বাস করবেন না।’’ নির্দল প্রার্থীরাও যাতে ‘ভোটকাটুয়া’ হয়ে উঠতে না-পারেন, সে ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন মমতা। উদাহরণ দিয়েছেন বিহারের। বলেছেন, ‘‘বিহারে চালাকি করে চারটে করে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। নির্দলেরা ভোট কাটলে লোকসান আপনার। সুবিধা হবে বিজেপি-র।’’ তৃণমূলনেত্রী আরও বলেন, ‘‘কিছু পোকামাকড় থাকবেই। ওরা প্রকৃতির জীব। ওদের সরিয়ে দিয়ে নিজের কাজটা করুন।’’
কিন্তু সংখ্যালঘু নেতা হুমায়ুনকে শাস্তি দেওয়ার সময় মমতাকে অন্য একটি বিষয়ও খেয়াল রাখতে হয়েছে। তা হল, তিনি একজন সংখ্যালঘু জনপ্রতিনিধিকে শাস্তি দিচ্ছেন, এই সিদ্ধান্তের যেন কোনও ‘ভুল ব্যাখ্যা’ না হয়। সেই কারণেই হুমায়ুনকে সাসপেন্ড করার ঘোষণাটি করেছেন সংখ্যালঘু নেতা ববি। যিনি ইদের দাওয়াত দেন, আবার চেতলায় কলকাতার অন্যতম বড় দুর্গাপুজোটিও করেন। ফলে ফিরহাদকে দিয়ে হুমায়ুনকে সাসপেন্ড করার ঘোষণা করানো তৃণমূলের ‘সুচিন্তিত’ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে করা হচ্ছে। সেই কারণেই ববির সঙ্গে রাখা হয়েছিল মুর্শিদাবাদেরই দুই বিধায়ককে। ঘটনাচক্রে, তাঁরাও সংখ্যালঘু অংশের।
ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় পোর্টালে নথিভুক্ত করার সরকারি নির্দেশিকা নিয়ে সংখ্যালঘু মহলে ইতিমধ্যেই নানাবিধ গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বহরমপুরের সভা থেকে মমতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, নতুন করে মুর্শিদাবাদে হিংসা তৈরির ছক কষা হতে পারে। ওয়াকফ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ‘ভুয়ো খবর’ রটানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন মমতা। সন্দেহ নেই ওয়াকফ সংখ্যালঘুদের কাছে ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়। তৃণমূলে কারও কারও এ-ও আশঙ্কা, এই বিষয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে বিজেপি-ও নানা কৌশল নিতে পারে। সে সব সাত-পাঁচ ভেবেই মমতা ওয়াকফ নিয়েও সতর্ক করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে কিছু দুষ্কৃতী গুজব রটাচ্ছে, রাজ্য সরকারি কালেক্টরেটে খতিয়ান নম্বরে মসজিদ, কবরস্থান, ধর্মীয় স্থানগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। মিথ্যে কথা! সব ধর্মেই কিছু গদ্দার থাকে, যারা বিজেপির টাকা খেয়ে মিথ্যা প্রচার করে।’’
প্রসঙ্গত, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই গত এপ্রিলে হিংসার আগুনে পুড়েছিল মুর্শিদাবাদের সুতি, শমসেরগঞ্জের মতো এলাকা। মমতার সতর্কবার্তা, আবার সেই রকম ঘটনা ঘটানোর ‘ছক’ কষা হচ্ছে। যাতে মামলাগুলিতে এনআইকে-কে দিয়ে ভোটের আগে লোকজনকে গ্রেফতার করাতে যায়। বস্তুত, এসআইআর পর্বে মমতা যে জনসভাগুলি করছেন, সেই জায়গাগুলিও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। গত সপ্তাহে মমতা জনসভা এবং পদযাত্রা করেছিলেন মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁয়। বুধ এবং বৃহস্পতিবার জনসভা করলেন মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে। দু’টি জেলাই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। আগামী সপ্তাহে তাঁর যাওয়ার কথা কোচবিহারে। যেখানে রাজবংশীদের আধিক্য রয়েছে।
তবে মতুয়া ভোট গত কয়েকটি নির্বাচনে তৃণমূলের দিকে না-থাকলেও সংখ্যালঘু ভোট এখনও মমতার দিকেই রয়েছে। বিজেপি যখন হিন্দু ভোটকে একত্রিত করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, তখন মমতাও তাঁর ভোটের ‘পুঁজি’কে সুরক্ষিত রাখতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই সূত্রেই মুর্শিদাবাদের সভা থেকে নানা বার্তা দিয়েছেন তিনি। সংখ্যালঘুদের ‘পাহারাদার’ হিসাবে তুলে ধরেছেন নিজেকে। বলেছেন, ‘‘আমার উপর বিশ্বাস আছে তো? মুর্শিদাবাদে দাঙ্গা হতে দেবেন না। মনে রাখবেন, আমি আপনাদের পাহারাদার। আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না।”
ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় পোর্টালে নথিভুক্ত করার সরকারি নির্দেশিকা নিয়ে সংখ্যালঘু মহলে নানাবিধ গুঞ্জন রয়েছে। বহরমপুরের সভা থেকে মমতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, নতুন করে মুর্শিদাবাদে হিংসা তৈরির ছক কষা হতে পারে। ওয়াকফ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভুয়ো খবর রটানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন মমতা। সন্দেহ নেই ওয়াকফ সংখ্যালঘুদের কাছে স্পর্শকাতর বিষয়। তৃণমূলে কারও কারও এ-ও আশঙ্কা, এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে বিজেপি-ও নানান কৌশল নিতে পারে। শাসকদলের অনেকের বক্তব্য, সেই সব সাত-পাঁচ ভেবেই মমতা ওয়াকফ নিয়েও সতর্ক করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে কিছু দুষ্কৃতী গুজব রটাচ্ছে, রাজ্য সরকার কালেক্টরটে খতিয়ান নম্বরে মসজিদ, কবরস্থান, ধর্মীয় স্থানগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। মিথ্যে কথা। সব ধর্মেই কিছু গদ্দার থাকে, যারা বিজেপির টাকা খেয়ে মিথ্যা প্রচার করে।’’ ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকেই গত এপ্রিল মাসে হিংসার আগুনে পুড়েছিল মুর্শিদাবাদের সুতি, শমসেরগঞ্জের মতো এলাকা। মমতা সতর্ক করে বার্তা দিয়েছেন, ফের সেই রকম করার ছক করা হচ্ছে। যাতে মামলাগুলি এনআইকে-কে দিয়ে ভোটের আগে লোকজনকে গ্রেফতার করাতে পারে।
এসআইআর-পর্বে মমতা যে জনসভাগুলি করছেন, তার জায়গাগুলি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। গত সপ্তাহে মমতা জনসভা এবং পদযাত্রা করেছিলেন মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁয়। বুধ এবং বৃহস্পতিবার জনসভা করলেন মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে। যে দু’টি জেলাই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। আগামী সপ্তাহে তাঁর যাওয়ার কথা কোচবিহারে। যেখানে রাজবংশী মানুষজনের আধিক্য রয়েছে। তবে মতুয়া ভোট গত কয়েকটি নির্বাচনে তৃণমূলের দিকে না-থাকলেও সংখ্যালঘু ভোট মমতার দিকেই রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতেই হুমায়ুনের শাস্তি। তবে হুমায়ুন সংখ্যালঘুদের মধ্যে কতটা প্রভাব তৈরি করতে পারবেন বা আদৌ পারবেন কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত নয় দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকে। এক নেতার কথায়, ‘‘হুমায়ুনের ব্যক্তিপ্রভাব যদি এতই থাকত, তা হলে তাঁকে এত বার দলবদল করতে হত না!’’ উল্লেখ্য, হুমায়ুন একটা সময়ে কংগ্রেস করতেন। ছিলেন অধীর চৌধুরীর ঘনিষ্ঠবৃত্তের নেতা। তার পরে যোগ দেন তৃণমূলে। রেজিনগরে উপনির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে হেরে চলে যান বিজেপি-তে। ২০২১ সালের ভোটের আগে আবার তিনি তৃণমূলে ফেরেন। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ২০২৬-এর ভোটে তৃণমূলেও থাকবেন না তিনি। আগামী দু’একদিনের মধ্যেই বিধায়ক পদে ইস্তফা দেবেন বলে হুমায়ুন বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন। নতুন দল নিয়ে আগামী বিধানসভা ভোটের ময়দানে নামতে চলেছেন তিনি। রাজ্যের ১৩৫টি আসনে তাঁর দলের প্রার্থীরা লড়বেন এবং তৃণমূল-বিজেপি-কে দেখিয়ে দেবেন তাঁর কত ‘দম’।
গত দেড়-দু’মাস ধরে হুমায়ুন তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উচ্চগ্রামে সরব ছিলেন। কিন্তু তার পরেও তিনি যে বৃহস্পতিবার মমতার সভায় যেতে পারেন, সেই ধারণা অনেকেরই ছিল না। দলের বিধায়ক হিসাবে তাঁকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সভাস্থলে মঞ্চে উঠতে গিয়ে হুমায়ুন জানতে পারেন, তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের অনেকে অর্জুন সিংহের ঘটনার মিল পাচ্ছেন। গত লোকসভা ভোটের আগে ব্রিগেড সমাবেশে অর্জুন ছিলেন তৃণমূলের মঞ্চে। আশা করেছিলেন, ব্যারাকপুরে তাঁকেই টিকিট দেবেন মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যারাকপুরের প্রার্থী হিসাবে পার্থ ভৌমিকের নাম ঘোষণা হতেই মঞ্চ থেকে নেমে সোজা গাড়িতে উঠে ব্রিগেড ছেড়েছিলেন তিনি। তার পরে গিয়েছিলেন বিজেপি-তে। হুমায়ুন অবশ্য মঞ্চেও উঠতে পারেননি!