ধর্মতলার সভায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পণ্ডিত কাক, বি-এ পাশ ছাগল, উকিল কুমীর আর হাকিম হুতোম প্যাঁচা। এদের নিয়েই হ য ব র ল-র কাহিনি শুনিয়েছিলেন সুকুমার রায়।
ধর্মতলায় মঙ্গলবার ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে বারবার শোনা গেল ‘হ য ব র ল’-র কথা! শোনালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাহিনি জুড়ে লাল, সবুজ এবং গেরুয়া রঙের বিরোধীরা! অর্থাৎ সিপিএম, কংগ্রেস এবং বিজেপি। ‘হ য ব র ল’ দিয়েই শুরু হয়ে গেল ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের জন্য মমতার প্রস্ততি।
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে শেষ ‘শহিদ সমাবেশে’র উপচে পড়া ভিড়ের সামনে তীব্র কটাক্ষ মিশিয়েই তৃণমূল নেত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, বিরোধীরা যত এককাট্টা হয়ে তাঁকে হারানোর চেষ্টা করবে, ততই তাদের ভরাডুবি হবে। এই মঞ্চ থেকেই মমতার ঘোষণা, বিধানসভা ভোটে তাঁরা একাই লড়বেন। এবং বিপুল সংখ্যায় আসন জিতে সরকারে ফিরে এসে পরের বারের ২১শে-র রেকর্ড-ভাঙা সমাবেশ করবেন ব্রিগেড ময়দানে।
সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন নির্বাচনের রেকর্ড দেখলে তৃণমূলই বিরোধীদের চেয়ে হেসেখেলে এগিয়ে! অথচ এমন রেকর্ড নিয়েও তৃণমূল নেত্রী এ দিন কেন বিরোধীদের ‘হ য ব র ল’ বলে কটাক্ষ করতে গেলেন? এক বার নয়, অন্তত পাঁচ বার তাঁর মুখে শোনা গেল ‘হ য ব র ল’-র কথা। বিরোধী শিবির এবং শাসক দলেরও একাংশের ব্যাখ্যা, তৃণমূল নেত্রীর এই আক্রমণই আসলে বিরোধীদের প্রয়াসের স্বীকৃতি! আসলে মমতাও জানেন, কোনও ভাবে পতাকার ব্যবধান ভুলে তৃণমূল স্তরে বিরোধীরা যদি এক মঞ্চে আসতে পারে, তা হলে বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের যাত্রা মসৃণ হবে না। এই আশঙ্কা থেকেই আগাম তাদের নস্যাৎ করে আক্রমণে যাওয়ার কৌশল।
শাসক যখন শক্তিশালী, তাদের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার চেষ্টা বরাবরই করে থাকে বিরোধীরা। সিপিএম যখন প্রবল দাপটে ক্ষমতায়, বিরোধী ভোট বিভাজনের সুযোগ তারা পূর্ণ মাত্রায় পেয়েছে। পরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের প্রেক্ষিতে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের সঙ্গে আরও নানা ছোট দলকে প্রথমে আন্দোলনের এক মঞ্চে এনেছিলেন মমতা। তার পরে সেই মঞ্চই নির্বাচনী সমঝোতায় এগিয়ে গিয়ে বামফ্রন্টের পতন ঘটিয়েছিল। নিজের পুরনো অভিজ্ঞতা থেকেই শাসক মমতা বিরোধীদের এই প্রচেষ্টার বিপদ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যা, সেই জন্যই বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস দূরে দাঁড়িয়ে তিনি বাম-কংগ্রেস-বিজেপি’কে এক বন্ধনীতে ফেলে দেখাতে চাইলেন, বিরোধীরা আসলে নীতিহীন সমঝোতার পথে যেতে চাইছে। একই সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি থাকার বার্তা দিয়ে রাখলেন নিজের দলের নেতা-কর্মীদেরও।
বস্তুত, এ দিনের মঞ্চ থেকে বিরোধীদের উদ্দেশে মমতার মন্তব্য যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস-সিপিএম দু’দলকেই বলছি, কোনও রাজনৈতিক দলের আদর্শের মৃত্যু না হলে তাদের মৃত্যু হয় না। কিন্তু আদর্শ এবং নীতির মৃত্যু হলে দলেরও মৃত্যু। আপনাদের রাজনৈতিক দর্শন নেই, রাজনৈতিক ধর্ম নেই!’’ কংগ্রেস এবং বামেদের একাংশ যে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলার প্রস্তাব নিয়ে চর্চা চালাচ্ছে, সেই দিকেই তৃণমূল নেত্রীর ইঙ্গিত স্পষ্ট। এর সঙ্গেই বিজেপি-কে জুড়ে দিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস-বিজেপি-সিপিএম হ য ব র ল হয়ে গিয়েছে! হ য ব র ল এবং দাঙ্গাবাজদের এ রাজ্যে কোনও স্থান নেই।’’ আরও বলেছেন, ‘‘দরকারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সরকার চালাব। তবু আপনাদের কাছে মাথানত করব না। আমরা একাই ল়ড়ব। যারা হ য ব র ল করে স্বপ্ন দেখছে, তাদের বলতে চাই মরা গাঙে বান এসেছে, এ বার জয় মা বলে ভাসা তরী— এটা তোমাদের হবে না!’’
তৃণমূল শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, কয়েক মাস আগে পুরভোটে বিপুল সাফল্য পেয়েছে মমতার দল। কিন্তু সেই নির্বাচনেও কলকাতার ওয়ার্ডভিত্তিক পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে, কংগ্রেস এবং বামেদের ভোট যোগ করলে প্রায় ৪০টি আসন হারাতে হতো তৃণমূলকে। আগামী বছরের বিধানসভায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং কংগ্রেস-বাম কাছাকাছি এসে লড়লে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছু বিধানসভা আসনের ফল এ দিক-ও দিক হওয়াই স্বাভাবিক। আনুষ্ঠানিক ভাবে জোট ছাড়াও অভিন্ন কোনও মঞ্চ যদি হয়, সেখানে গিয়ে যোগ দিতে পারে শাসক দলের বিক্ষুব্ধ অংশ। এমন একটি যৌথ মঞ্চ মমতার সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কেও ভাঙন ধরাতে পারে। ইতিমধ্যেই যে কারণে সংখ্যালঘুদের কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন তৃণমূলে ব্রাত্য নেতা মুকুল রায়। এই যাবতীয় তৎপরতা মাথায় রেখেই এ দিন ‘হ য ব র ল’ আক্রমণে গিয়েছেন মমতা। শাসক দলেরই এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘সম্প্রতি যে সব ঘটনা ঘটছে, তার প্রেক্ষিতে সরকারে থেকে বিধানসভা ভোটে একক ভাবে ৪০%-এর বেশি ভোট পাওয়া কঠিন। উল্টো দিকে তৃণমূল স্তরে বিরোধীরা যদি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে ফেলতে পারে, তা হলে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে।’’
মমতার মন্তব্যে আশঙ্কার পরোক্ষসুর ধরে ফেলেই সরব বিরোধীরাও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র তৃণমূল নেত্রীকে কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন, ‘‘হ য ব র ল বলে যদি কেউ থাকেন, তা হলে তার সব চেয়ে বড় উদাহরণ উনি। কারণ, উনি এক দিকে উগ্র বামপন্থী, অন্য দিকে ডানপন্থীদের জুটিয়ে তৃণমূল দল গড়েছেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ভোট লড়েছেন। ওঁর আদর্শ বলে কিছু নেই!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘ওঁরাই কংগ্রেসকে সাইনবোর্ড বলেন। আবার এখন কংগ্রেসকেই ভয় পাচ্ছেন!’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, ‘‘সিপিএমকে ফিশ ফ্রাই খাইয়ে কারা বলেছিল, আপনারা কেন পার্টি অফিস রক্ষা করতে পারছেন না? আর সনিয়া গাঁধীর ইফতারে গিয়ে তৃণমূল বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া হয়েছে এবং তা জোরদার হচ্ছে!’’ তাঁর দলেরই বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘যাদের দলটাই তৈরি হয়েছে হাঁসজারুর আদতে, তারা অন্যদের মধ্যে হ য ব র ল-ই দেখবে!’’
গত কয়েক মাসে কেন্দ্রে বিজেপি-র সরকারের সঙ্গে তৃণমূলের সখ্যের অভিযোগ নিয়ে বারবার সরব হয়েছে বাম এবং কংগ্রেস। এই প্রচার যত বাড়বে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু সমর্থনে তত ধাক্কা লাগার আশঙ্কা। ওই প্রচারের জবাব দেওয়ার জন্যই মমতা এ দিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূলের আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। আগে আন্দোলন করেছি সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এখন চলবে কেন্দ্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে। বাংলা থেকে এই আন্দোলন দিল্লির মাটিতে ছড়িয়ে পড়বে।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিভিন্ন প্রকল্প ধরে ধরে এ দিন তার সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সারদা-কাণ্ড বা সিবিআই নিয়ে কোনও শব্দ খরচ না করলেও বিজেপির উদ্দেশে বলেছেন, ‘দাঙ্গাবাজদের দলে’র কাছে থেকে তিনি দুর্নীতি নিয়ে কোনও শিক্ষা নিতে রাজি নন! এক দিকে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর ধরে রেখে কংগ্রেস-বামেদের সঙ্গে গেরুয়া শিবিরকে জড়িয়ে দিয়ে সংখ্যালঘু জনতাকে বার্তা দিতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
একুশের জনসভায় শুভেন্দু-মমতা।
বিরোধীদের মোকাবিলার পাশাপাশিই মমতা জানেন, ২০১৬-র বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তাঁর নিজের ঘরও গুছিয়ে রাখা জরুরি। সেই লক্ষ্যেই এ দিন শৃঙ্খলা রক্ষায় দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি কড়া বার্তা শোনা গিয়েছে তৃণমূল নেত্রীর গলায়। আবার অন্য দিকে আরও বেশি মানুষের মন পেতে জনমোহিনী নীতির ডালপালা ছড়িয়ে শস্তায় চাল দেওয়ার প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশকেই এনে ফেলার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাদ দেননি সংখ্যালঘু এবং তফসিলিদের জন্য তাঁর উন্নয়ন প্রকল্পের ফিরিস্তিও। দলনেত্রীর আগেই তরুণ সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট ভাবে যে তাগিদকে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন— ‘‘শহিদদের স্মৃতিকে সামনে রেখে ২০১১ সালে আমরা জিতেছিলাম নেতিবাচক ভোটে। ২০১৬ সালে আমাদের জিততে হবে উন্নয়নের কথা বলে, ইতিবাচক ভোটের মাধ্যমে।’’
এক দিকে ‘হ য ব র ল’-র বাধা টপকানোর তাগিদ। অন্য দিকে, দলের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে এবং জনমোহিনী প্রশাসনের মুখ দেখিয়ে মন জয়ের চেষ্টা। মমতার ‘মিশন ২০১৬’ শুরু হয়ে গেল ২১শে-র ধর্মতলা থেকেই!
— নিজস্ব চিত্র