হাসপাতাল নিয়ে কড়া মমতা, অসৎ ব্যবসা চালু থাকলে লাইসেন্স রদ

কলকাতার কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষের ভূরি ভূরি অভিযোগ। বুধবার টাউন হলে বৈঠক ডেকেছিলেন উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। সামনে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তারা। তাঁদের উদ্দেশে যা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কলকাতার কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষের ভূরি ভূরি অভিযোগ। বুধবার টাউন হলে বৈঠক ডেকেছিলেন উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী। সামনে বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তারা। তাঁদের উদ্দেশে যা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৯
Share:

হাসপাতাল কর্তাদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার টাউন হলে রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

অনেক দিন থেকেই এই রকম একটা মিটিং করবো ভাবছিলাম। কোথাও-কোথাও এত অবহেলা হচ্ছে, কোথাও এত বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে, রোগী মারা গেলে ঘটি-বাটি বিক্রি করে লোকে বডি ফেরত পাচ্ছে। কখনও তা-ও পাচ্ছে না! ‘এক্সট্রা চার্জ’ এর সমস্যা সব চেয়ে বেশি। তবে রোগীর বাড়ির লোকদের অনুরোধ করব, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।

Advertisement

আমরা গত পাঁচ বছরে ২৭ হাজার শয্যা বাড়িয়েছি। নট আ ম্যাটার অব জোক। কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। এটা সত্যি যে সরকারি হাসপাতালে সবাই বেড পায় না। আবার অনেকে নিজের ইচ্ছাতেও বেসরকারি হাসপাতালে যান। হাসপাতালগুলো প্রচণ্ড চার্জ নিচ্ছে। এত টাকা নিচ্ছে যে যাঁরা বাইরে থেকে আসেন, তাঁরা বলছেন আর আসবেন না।

লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীর অপারেশন করেছে একটা হাসপাতাল! এর থেকে বড় আনএথিকাল কাজ আর হয় না! দুমদাম বিল বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকী এমনও হয়েছে যে, ওদের কোনও এক জনের বুটিক থেকে ডাক্তারদের শাড়ি কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। ডাক্তারদের টেস্ট লিখতে বাধ্য করা হয়। আমি ডাক্তারদের দোষ দেখি না। ওঁরাও বিরক্ত, অসহায়। ডাক্তারদের বলব, তাঁরা যদি বেসরকারি জায়গায় অসুবিধায় পড়েন, তা হলে সরকারি হাসপাতালে তাঁদের স্বাগত।

Advertisement

এখন বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রমণের ভয় সব চেয়ে বেশি। নিয়ম হচ্ছে, এক জন রোগী চলে যাওয়ার পরে ভাল করে বিছানা পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু সে সব এখন হয় না। প্যাকেজ আবার প্লাস প্যাকেজ হয়ে যাচ্ছে। হার্ট অপোরেশনের প্যাকেজ দেড় লক্ষ টাকা বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে রোগী আনছেন। তার পরে অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আইসিসিইউ ভেন্টিলেশনে। চড়চড়িয়ে বিল বে়ড়ে যাচ্ছে।

মনে রাখবেন এটা কলকারখানা নয়। সেবা বিক্রি হয় না। ইট-কাঠ-খড়ের ইন্ডাস্ট্রি আর মানুষের জীবন বাঁচানোর ইন্ডাস্ট্রি এক নয়। আগে মানুষকে অক্সিজেন-স্যালাইনটুকু দিন। এমন ব্যবস্থা করুন যাতে সুলভে চিকিৎসা দিতে পারেন। আমি বলছি না আপনারা লোকসান করুন, কিন্তু ১০০% লাভ করাটাও চলতে পারে না। ভাবতে পারেন, এক জনের হয়েছে পেটের রোগ, তার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত টেস্ট করাচ্ছে! এত টেস্ট কীসের? আমাদের ছোটবেলায় তো ডাক্তারবাবু একটা দু দাগের মিক্সচার দিতেন, কাজ হয়ে যেত।

বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। বিল বাড়ানোর জন্য আইসিইউ-আইটিইউতে ঢুকিয়ে ৫ লক্ষ, ১০ লক্ষ নেওয়া হচ্ছে। মানুষ কোথায় পাবে এত টাকা? আপনাদের অনেকে বলেছেন, মুম্বই-চেন্নাইয়ে চিকিৎসার খরচ আরও বেশি। আরে বাবা সেখানে মানুষের হাতে অনেক বেশি পয়সা, লাইফ স্টাইল আলাদা। মনে রাখবেন, কলকাতায় এখনও ২০-৩০ টাকায় দুপুর বা রাতের খাবার মেলে।

আরও পডুন: মমতার মানবিক মুখে উচ্ছ্বসিত দল

ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি হয়নি, অথচ হয়েছে বলে হাসপাতালে ঢুকিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে। এ বার থেকে কিন্তু স্যাম্পেল রাখতে হবে! প্লেটলেট কাউন্ট নামেনি, বলে দিচ্ছে ডেঙ্গি! প্যানিক করে দিচ্ছে। সামনেই ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার সিজন শুরু হচ্ছে। চলবে নভেম্বর পর্যন্ত। ডেঙ্গি পরীক্ষা নিয়ে যা ইচ্ছে করবেন, সেটা চলবে না। আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। আমার একটা বডি পার্টস বাদ গিয়েছিল, তার পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছিল। ব্যথা হচ্ছে উপরের দাঁতে, তুলছে নীচের দাঁত, ভাবা যায়! ইজ ইট নট আ ক্রাইম?

ওরা ট্রেন্ড নার্স, ট্রেন্ড কর্মী নিচ্ছে না। স্যালাইনের নল লাগাতে গিয়ে গলগল করে রক্ত বার করে দিচ্ছে। মানুষ তো এতেই ইরিটিটেড হয়ে যায়। আপনারা বলবেন, আমি এত সব কী করে জানলাম? আরে আমি তো অনেক বার মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এমন সব লোক যে আমার ইঞ্জেকশন দেওয়ার ভেন খুঁজে পাচ্ছিল না! ড্রাই অক্সিজেন সিলিন্ডার চালিয়ে দেয়। কী ডেঞ্জারাস!

খুব সতর্ক ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করুন। মানুষ সবাই ভাল, বুদ্ধিমান। কিন্তু প্রিয়জন মারা গেলে মাথার ঠিক থাকে না। সেই সময়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ান, অভিযোগ শুনুন। সার্ভিস উইথ স্মাইল। যদি দেখেন যে তাঁর টাকা নেই, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বলুন, ‘‘বাবু তোর টাকা নেই ঠিক আছে, আমরা ইমার্জেন্সি চিকিৎসাটা করে দিচ্ছি।’’ তার পর একটু প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট করে স্টেবল করে কোথাও রেফার করুন। দরকারে সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। হয়তো হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে, অনেকে হয়তো রাস্তা থেকে আহত বা অসুস্থ লোককে তুলে এনেছে। ছোটখাটো হেল্প করে দেবেন। এতে তো বরং ঘরে লক্ষ্মী আসে। আমি চাই বাংলা এ ব্যাপারে মডেল হোক। লোকে আমাদের দেখে শিক্ষা নিক। আমার পরিচিত বাংলাদেশের এক জনের আত্মীয় অ্যাপোলোয় ভর্তি আছেন। ২০ লক্ষ টাকা বিল হয়ে গিয়েছে। কান মুলে টাকা নিচ্ছে। ওঁরা বলছেন, এ বার দেশে গিয়ে সবাইকে বলবেন, এখানে যেন কেউ না আসে। জেনারেল মেডিসিন কত গুরুত্বপূর্ণ। এখন সব সুপার স্পেশ্যালিটি হয়ে গিয়েছে। হার্ট এক জন দেখবে, ব্রেন এক জন দেখবে, চোখ এক জন দেখবে। ৫০টা স্পেশ্যালিটি। মানুষ একটা! ক’জন ডাক্তার ডাকবেন? ক্রিটিক্যাল কেয়ার ট্রিটমেন্টের নামে মানুষের অবস্থাই ক্রিটিক্যাল করে দিচ্ছে!

ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি করবেন। রোগীর ইনফেকশন যেন না-হয়। আবার বলছি, অ্যাপোলো কিন্তু যা-তা করছে। ১৫-১৬ লক্ষ টাকা বিল! ৪০% কমিশন নেয় ডাক্তারদের থেকে। সব জেনে যাচ্ছে পাবলিক, সব নজরে রাখছি আমরা। হেল্প ডেস্ক করতে হবে, ভেন্টিলেশন প্রোটোকল মানতে হবে, ই-প্রেসক্রিপশন, ই-রেকর্ড রাখতে হবে, সব অনলাইন করতে হবে, মৃতদেহ আটকে রাখা যাবে না। বার বার একই অভিযোগ হলে লাইসেন্স কেড়ে নেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন