শিল্প গড়ার জমি রাজ্যের কাছে আছে কি? বণিকসভায় উঠে এল প্রশ্ন

মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুরু হওয়ার আগেই শিল্পপতিদের হাতে হাতে কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হল। তাতে পরিসংখ্যান দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে রাজ্যের বাড়বাড়ন্তের তুলনামূলক চিত্র। তবুও সেই অমোঘ প্রশ্ন উঠেই এল। শিল্প গড়ার জমি রাজ্যের কাছে আছে কি ? আর যদিও বা থাকে, তা কত দ্রুত বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব ?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৩
Share:

বারে বারে ঘুরে আসছে শিল্পমহলের সেই পুরনো প্রশ্ন। এবং জবাবে নেত্রীর সেই পুরনো আশ্বাস। সংশয় তাই কাটছে না।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শুরুর আগেই দেশের তাবড় শিল্পপতিদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটি কাগজ। তাতে রীতিমতো পরিসংখ্যান দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে রাজ্যের বাড়বাড়ন্তের তুলনামূলক ছবিটি তুলে ধরা। কিন্তু এ সব পড়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার শেষে প্রশ্নটা তুললেন শিল্পপতিরা— শিল্প গড়ার মতো জমি রাজ্যের কাছে আছে কি? আর যদি থাকেও, তা কত দ্রুত বিনিয়োগকারীর হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব? প্রশ্ন উঠল শিল্পের উপযোগী পরিবেশ এবং পরিকাঠামো নিয়েও।

পুরনো এই প্রশ্নের জবাবটাও ছিল প্রত্যাশিত।

Advertisement

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বণিকসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আশ্বাস এত দিন দিয়ে এসেছেন, মঙ্গলবার সিআইআই-এর জাতীয় পরিষদের বৈঠকেও সেই একই কথা শোনা গেল তাঁর মুখে। কলকাতায় বড় হয়ে ওঠা মহিন্দ্রা অ্যান্ড মহিন্দ্রা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি পবন গোয়েন্কার জমি-সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জমি ব্যাঙ্ক রয়েছে। শিল্পের জন্য সেই ব্যাঙ্ক থেকে ৭৫০০ একর জমি দেওয়া হয়েছে। আপনি প্রকল্প করুন। জমি দেওয়া কোনও সমস্যা নয়।’’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন নিজেদের পুরনো ‘নীতি’র কথাও— কৃষকদের থেকে জোর করে জমি নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল।

শুধুই জমি ব্যাঙ্ক নয়। বিনিয়োগ টানার প্রায় সব রসদই রাজ্যে আছে বলে এ দিনও দাবি করলেন মমতা। জমি ব্যবহারের নীতি, বিভিন্ন জায়গায় জমির মানচিত্র ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ত জোগানের প্রসঙ্গ তোলেন সভায় উপস্থিত আইটিসি কর্তা যোগী দেবেশ্বর, গোদরেজ গোষ্ঠীর কর্ণধার আদি গোদরেজ, পেপসিকো ইন্ডিয়ার প্রধান ডি শিবকুমার, বজাজ গোষ্ঠীর প্রধান রাহুল বজাজ থেকে শুরু করে কির্লোস্কার গোষ্ঠীর সঞ্জয় কির্লোস্কার, টিআইএল প্রধান ও সিআইআই প্রেসিডেন্ট সুমিত মজুমদারের মতো শিল্প-কর্তারা।

জমি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস যে বিশেষ দাগ কেটেছে, তেমন আভাস অবশ্য মেলেনি অনুষ্ঠান শেষে শিল্পপতিদের কথায়। তবে কি সিঙ্গুর ঘটনার রেশ এখনও থিতিয়ে যায়নি? জমি নিয়ে প্রশ্ন-কর্তা পবন গোয়েন্কা সরাসরি সিঙ্গুর প্রসঙ্গ না তুলেও বলেন, ‘‘নেতিবাচক ঘটনা স্মৃতি থেকে দ্রুত মুছে যায় না। যে কোনও বিনিয়োগকারীর মনেই আশঙ্কা রয়েছে, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়। মুখ্যমন্ত্রী সক্রিয় হয়েছেন। তবে ভাবমূর্তি ফেরাতে অনেকটা চেষ্টা দরকার।’’ রাজ্য সরকারের জমি নীতি নিয়ে এর আগে বেশ কয়েক বার সরব হয়েছিলেন আদি গোদরেজ। এ দিন অবশ্য সরাসরি রাজ্য সরকারের কোনও সমালোচনা করেননি তিনি। তবে স্পষ্টই জানিয়েছেন, শিল্প গড়ার জন্য জমি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

শুধু জমি পাওয়াই সব নয়। জমি কোথায় দেওয়া হচ্ছে, শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে তা-ও এখন জরুরি হয়ে উঠছে। এক শিল্পকর্তার দাবি, সামাজিক পরিকাঠামোহীন জায়গায় জমি দিলে শিল্প গড়া কঠিন। কারণ দক্ষ কর্মী ধরে রাখতে উপযু্ক্ত সামাজিক পরিকাঠামো দরকার। সম্প্রতি সিআইআই-এরই একটি বৈঠকে এই সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন টাটা-হিতাচি কর্তৃপক্ষ। কলকাতা থেকে দূরত্ব বেশি না হলেও স্কুল, হাসপাতাল ও বিনোদনের পরিকাঠামোর অভাবে খড়গপুরের প্রকল্পে কর্মী টিকিয়ে রাখা সহজ হচ্ছে না বলে খোদ অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছে অভিযোগও করেছিলেন তাঁরা।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ সব বিষয়ে মাথাই গলাননি এ দিন। বরং ঘোষণা করেন, এ রাজ্যে ২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে এবং তাঁর আমলে একটি শ্রম দিবসও নষ্ট হয়নি। রাজ্যের উন্নয়ন প্রকল্পে যে ঘাটতি রয়েছে, তার দায় যথারীতি আগের সরকারের উপরেই চাপালেন তিনি। প্রতি বারের মতোই এ বারও বললেন, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হলেও রাজ্য স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পারছে না। কারণ গত সরকারের ঋণ শুধতেই ২৮ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে।

জমি নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলেও শিল্পমহল অবশ্য একটি বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সিআইআই-এর মতো জাতীয় বণিকসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী যে উপস্থিত হয়েছেন, তাতেই বিস্মিত অনেক শিল্পকর্তা। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বলেন, ‘‘এই শিল্প বৈঠকে আসা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’’ যদিও শিল্পকর্তারা মনে করাচ্ছেন যে, ১২০ বছরের পুরোনো বণিকসভা সিআইআই-এর প্রথা অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি একটি রেওয়াজ। বহু দিন পর্যন্ত পাঁচতারা হোটেলের অনুষ্ঠানে যেতে চাইতেন না মমতা। তিন বছর পরে মুখ্যমন্ত্রীর আগাম আশ্বাস পেয়ে ২০১৪ সালে জাতীয় পরিষদের বৈঠকের আয়োজন কলকাতায় করা হয়েছিল। কিন্তু অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্যে ব্যস্ত থাকায় সেই বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি তিনি। সেটা ভাল ভাবে নেননি অনেক শিল্পকর্তাই। অনেকেই সে দিন অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘বিনিয়োগের খরা চলছে যে রাজ্যে, সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী এমন সুযোগ হাতছাড়া করেন কী ভাবে?’’

এ দিন হাজির থাকলেও অবশ্য খুব বেশিক্ষণ এই অনুষ্ঠানে ছিলেন না মমতা। নিজেই জানিয়েছেন, দশটি পুজোর উদ্বোধন, ডান্ডিয়া নাচের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ও নবনির্বাচিত পুর প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের মাঝে তাঁর হাতে সময় কম। তাই দ্রুত বক্তৃতা শেষ করার আগে তিনি বলেন, ‘‘দুরন্ত ও রাজধানী এক্সপ্রেসের গতিতে ভাষণ শেষ করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন