হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মহম্মদ আমির। নিজস্ব চিত্র
চিড়িয়াখানায় ‘দিদি’র অনুষ্ঠানে সদলবলে ঢুকতে চেয়েছিলেন ‘ভাইয়েরা’। কিন্তু টিকিট না থাকায় নিরাপত্তারক্ষীরা আপত্তি করেন। কথা কাটাকাটির পরে অবশ্য টিকিট কেটেই ভিতরে যান ভাইয়েরা। তবে ঘটনাক্রম এখানেই থামেনি। বরং সেই শুরু।
পুলিশ সূত্রের খবর, সোমবার চিড়িয়াখানা থেকে ‘দিদি’ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেরিয়ে যেতেই মহম্মদ আমির নামে এক নিরাপত্তারক্ষীর উপরে চড়াও হন তৃণমূল সমর্থকেরা। তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। গুরুতর আহত অবস্থায় একবালপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে আমিরকে। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে উঠে এসেছে মহীতোষ সরকার নামে চিড়িয়াখানার স্থায়ী কর্মী তথা এক তৃণমূল কর্মীর নাম। যিনি আবার মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত।
কলকাতায় সরকারি কর্মীদের উপরে তৃণমূল সমর্থকদের হামলা এই প্রথম নয়। ২০১১ সালে রাস্তায় শব্দবাজি ও জোরে মাইক বাজানোর প্রতিবাদ করায় ভবানীপুর থানায় চড়াও হয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর আর এক ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গিয়েছিল। সেই রাতেই পুলিশের উপরে হামলায় ধৃতদের ছাড়াতে ভবানীপুর থানায় হাজির হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। চিড়িয়াখানার ঘটনায় অবশ্য মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
কী ঘটেছিল চিড়িয়াখানায়? পুলিশ ও চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, সোমবার বেলা ১১টা নাগাদ চিড়িয়াখানার নব কলেবরে তৈরি হওয়া সরীসৃপ ঘরের উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সে সময়েই জনা কুড়ি তৃণমূল সমর্থক বিনা টিকিটে চিড়িয়াখানার মূল ফটক দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিলে তাঁরা নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেন। বিনা টিকিটে ভিতরে যাওয়ার জন্য জোরাজুরিও করতে থাকেন। সে সময় মূল ফটকের দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষী মহম্মদ আমির তাঁদের বাধা দেন। এর পরে টিকিট কেটেই ওই কুড়ি জন ভিতরে ঢোকেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী চিড়িয়াখানা থেকে চলে যেতেই এক দল তৃণমূল সমর্থক এসে আমিরকে শাসিয়ে যান। এর পরে রাত আটটা নাগাদ তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ।
চিড়িয়াখানার উল্টো দিকের কর্মী আবাসনেই থাকেন আমির। মঙ্গলবার আমিরের দাদা মহম্মদ ওয়াসিম বলেন, “রাত আটটা নাগাদ আমি বাড়িতে ছিলাম। প্রতিবেশীরা এসে জানান, ভাইকে রাস্তায় ফেলে মারা হচ্ছে।” ওয়াসিমের অভিযোগ, চিড়িয়াখানার উল্টো দিকে, মাছঘরের সামনে মহীতোষ সরকারের নেতৃত্বে এক দল যুবক আমিরকে হকি স্টিক ও রিভলভারের বাট দিয়ে মারধর করে। তার পরেই আমির বমি করতে থাকেন। ওয়াসিম জানান, আমিরকে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁর সিটি স্ক্যান করাতে বলা হয়। জানানো হয়, অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর পরে রাতেই আমিরকে একবালপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, আমির চিড়িয়াখানার কংগ্রেস শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-র সমর্থক। তাঁকে মারধরে অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মীদের গ্রেফতারের দাবিতে সোমবার রাতে থানায় বিক্ষোভ দেখান কংগ্রেস সমর্থকেরা। চিড়িয়াখানার কংগ্রেস নেতা রাকেশ সিংহের অভিযোগ, “কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই আমিরকে মারধর করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের সময় কার্তিকবাবু চিড়িয়াখানায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর ওই নিরাপত্তারক্ষীকে বাড়ি ফেরার পথে পরিকল্পনা করে মারধর করা হয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, চিড়িয়াখানার কর্মী সংগঠন দখল করা নিয়েই এই হামলা। মহীতোষ সরকার-সহ ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার সকালে রাকেশ সিংহ দলবল নিয়ে মহীতোষের উপরে চড়াও হয়েছে বলে একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। সেই ঘটনাতেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
রাকেশ সিংহের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “মাস দুয়েক হয়ে গেল, আমি চিড়িয়াখানার দিকে যাই না। মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানেও ছিলাম না। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।” তবে মহীতোষ যে তাঁর পরিচিত, সেটা স্বীকার করেছেন কার্তিকবাবু। তাঁর কথায়, “মহীতোষের সঙ্গে পুজোর সময় আমার শেষ দেখা হয়েছিল।” মহীতোষবাবুও বলেন, “সাজানো ঘটনা। ওকে মারধর করা হয়নি। কোনও ভাবেই ওই নিরাপত্তারক্ষী জখম নন। নাটক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রাকেশ সিংহ চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।” চক্রান্ত এবং মহীতোষবাবুকে মারধর করার পাল্টা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাকেশ। তিনি বলেন, “আমি সকাল সাতটার সময় বিমানে দিল্লি রওনা হয়েছি। ফিরে পুলিশের কাছে সেই প্রমাণ দাখিল করব।”