খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পিছনে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হাত আছে বলে শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠেই গিয়েছিল। এ বার ওই মন্তব্য আদালতে অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার পথ সুগম করেবে কি না, সে প্রশ্নও তুললেন আইনজ্ঞ ও পুলিশের একাংশ।
বস্তুত, যে ভাবে এক জন মুখ্যমন্ত্রী দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাকে দেশের মাটিতে বিস্ফোরণের জন্য অভিযুক্ত করেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে তা অতি বিরল দৃষ্টান্ত। নেতাজি ইন্ডোরে গত শনিবার দলের কর্মিসভায় মমতা বলেন, “খাগড়াগড়ে হয়তো কেন্দ্রই ‘র’-কে দিয়ে বোমা রাখিয়েছে। মনে রাখবেন আমি ২৩ বছর কেন্দ্রে ছিলাম। কে কী ভাবে ষড়যন্ত্র করে সব জানি।” বিজেপি একে প্রকারান্তরে দেশদ্রোহিতা বলেই দাবি করছে।
আইনজীবী ও পুলিশ-কর্তাদের অনেকেও বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ মন্তব্যের পরে অভিযুক্ত পক্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে সব দোষ ‘র’-এর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারে। অভিযুক্তেরা এ ভাবে জামিনও পেতে পারে বলে মত আইনজ্ঞ ও পুলিশ কর্তাদের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর উচিত তাঁর অভিযোগের সমর্থনে প্রমাণ দাখিল করা, নচেৎ নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না-করলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারাও ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, এর পর তো ধৃতদের আইনজীবীরা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে হাতিয়ার করে আদালতের দ্বারস্থ হবে। এক জন মুখ্যমন্ত্রী যদি বলেন নাশকতা চক্রান্তের পিছনে ‘র’ রয়েছে, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ওই ব্যক্তিদের কেন গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে! বিরোধীরাও মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর ওই কথার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী কেন ‘র’-এর বিরুদ্ধে এফআইআর করেননি সেই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃতদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ছাড়াও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার চেষ্টার মতো কঠোর অভিযোগ এনেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। কলকাতা হাইকোর্টের এক আইনজীবীর ব্যাখ্যা, “মমতার মন্তব্যের জেরে ওই সব কঠোর ধারা কেন অভিযুক্তদের দেওয়া হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন তাঁদের আইনজীবীরা।” এমতাবস্থায় ধৃতেরা জামিন পেয়ে গেলে কে দায়িত্ব নেবে, সেই প্রশ্ন উঠছে।
কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যকে গণতন্ত্র এবং দেশের নিরাপত্তার পক্ষে খুবই অশুভ লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, যে কোনও বিচারাধীন বিষয়ে খুব সতর্ক হয়ে মন্তব্য করতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা বিচারব্যবস্থায় নাক গলানোরই সামিল বলে মনে করছেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও মুম্বই হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের মত হল, “রাজনীতিবিদরা নিজের মানসিকতা ও নীতিবোধ অনুযায়ী কথা বলেন। তবে তদন্তের এই পর্যায়ে এতে আদালত অবমাননার প্রশ্ন ওঠে না। কেন না, এখনও বিচার শুরু হয়নি।”
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এত দিন পরে হঠাৎ ‘র’-কে নিয়ে মুখ খুললেন কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মন্তব্য, “সত্যকে বিকৃত করা উচিত নয়। এতে দুষ্কৃতীরা উৎসাহ পায়।” আর মুখ্যমন্ত্রী যদি ‘সত্য’ বলে থাকেন, তা হলে তার প্রমাণ দিতে হবে বলে দাবি তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্বশীল পদে আছেন। তিনি যখন ‘র’-কে জড়িয়ে এমন সংবেদনশীল মন্তব্য করেছেন, তখন ওই গোয়েন্দা সংস্থার কোন কোন অফিসার সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের নামও নিশ্চয় তাঁর জানা।” অরুণাভবাবুর বক্তব্য হয় মুখ্যমন্ত্রী সেই তালিকা প্রকাশ করুন, নয়তো আদালতে লড়াই করে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে আনুন।
আইনজ্ঞ ও পুলিশ কর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলিও মমতার ওই মন্তব্য নিয়ে সরব। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আগের দিনই নিজের ব্লগে মমতাকে আক্রমণ করে লিখেছিলেন, “মমতার মন্তব্য ভারত-বিরোধী শক্তিগুলিরই হাত শক্ত করবে।” কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলছেন, “একের পর এক ঘটনা প্রমাণ করে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বলে কোনও বস্তু নেই। তার মধ্যে মমতার এই মন্তব্য দেশবিরোধী শক্তিগুলিকে আরও মদত দেবে।” রাজ্যের বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যর মন্তব্য, “মমতাই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রী, যিনি ‘র’-কে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করালেন।” পাশাপাশি যে ভাবে বিস্ফোরণের পর এনআইএ-কে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেগুলিও দেশদ্রোহিতার নামান্তর বলে মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। বিজেপির অন্য এক নেতার যুক্তি, মুম্বই বিস্ফোরণে এত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান মানতে চায়নি যে ওই হামলার পরিকল্পনা তাদের দেশে হয়েছিল। এ বার ভবিষ্যতে এমন কোনও হামলা বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে মমতার উদাহরণ তুলে বলা হবে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাই ওই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
‘র’-কে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে ‘র’ (কাঁচা) বলে আখ্যা দিচ্ছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে মমতা দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তা হলে কি ধরে নিতে হবে, কোন সংস্থা অতীতে কী করেছে, সে সব জেনেই তিনি এ কথা বলছেন?” সেলিমের আরও প্রশ্ন, “খাগড়াগড়ের ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, তা যদি মুখ্যমন্ত্রী জেনে থাকেন, তা হলে সেই সংস্থার বিরুদ্ধে এফআইআর করাননি কেন? এটা তো কর্মিসভায় বলার বিষয় নয়!”
মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের ধাক্কা কী হতে পারে, তা আজ বুঝতে পেরেছেন সংসদে হাজির হওয়া অল্প কয়েক জন তৃণমূল সাংসদও। মমতার ওই মন্তব্য যে তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলেছে, তা ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করে নিচ্ছেন তাঁদের একংাশ। তৃণমূল সূত্র বলছে, ঠিক হয়েছিল খাগড়াগড়ের দায় চাপানো হবে কেন্দ্রের ঘাড়ে। অনুপ্রবেশ রোখার দায় বিএসএফের বলে রাজ্যের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলা হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে দলনেত্রী যে কয়েক ধাপ এগিয়ে এমন কথা বলে বসবেন, তা ভাবতে পারেননি দলের পোড় খাওয়া নেতারাও। তৃণমূলের তরফে অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একান্ত আলোচনায় তৃণমূলের একাধিক নেতার মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী কখন কী বলছেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।” মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে তাই প্রতিক্রিয়া দিয়েও ‘বিপদ’ ডেকে আনতে চাইছেন না কোনও তৃণমূল নেতাই।
কংগ্রেস, জেডিইউ বা বিজেপি-বিরোধী অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে কক্ষ সমন্বয়ের প্রশ্নে তৃণমূলের পাশে দাঁড়ালেও খাগড়াগড় কাণ্ডে মুখে কুলুপ এঁটেছে। তদন্ত চলছে তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না গোছের মন্তব্য করেই দায় এড়িয়েছেন তাঁরা। ঘনিষ্ঠ মহলে সকলেই স্বীকার করছেন, এক জন মুখ্যমন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্য করা কখনওই উচিত নয়। এতে দেশবিরোধী শক্তিই আরও মদত পাবে।