শুক্রবার নবান্নে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী।
উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে বৃহস্পতিবার ত্রাণ দিতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। সেই বিক্ষোভে কোনও ঝান্ডা না-থাকলেও অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে শাসক দলকেই। সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি, ত্রাণ ঘিরে কেউ যেন রাজনীতি না-করেন। বিপন্ন মানুষদের ত্রাণের ব্যবস্থা রাজ্য সরকারই করবে।
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পিছনে অবশ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই দেখছেন বিরোধীরা। তাঁদের একাংশের মতে, নিজের উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে আরও কিছু বিপন্ন এলাকায় যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন রূপা। তাঁর সেই যাত্রা ভঙ্গ করতেই লন্ডন থেকে ফিরে তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রী ‘রাজনীতি না-করা’র আবেদন জানালেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রূপার পাশে দাঁড়ায়নি তাঁর নিজের দলই। হাবরা-অশোকনগরের ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ দিতে গিয়ে বৃহস্পতিবারই ধাক্কাধাক্কি, গালিগালাজ হজম করে ফিরতে হয়েছিল রূপাকে। পরে তাঁর নামে হার ছিনতাই এবং মারধরের অভিযোগও থানায় জমা পড়েছে! শুক্রবার বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘রূপা গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে বা দলের রাজ্য কমিটিকে জানিয়ে হাবরা যাননি। ওই সফরে দলীয় পতাকাও ব্যবহার হয়নি। তবে বিজেপি কর্মীদের ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ঠিক নয়।’’ বৃহস্পতিবার রূপা যেখানে ত্রাণ দিতে গিয়েছিলেন, আজ, শনিবার সেখানেই পাল্টা প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছেন রাহুলবাবু!
দলের রাজ্য সভাপতির এই মন্তব্যে যথেষ্ট ‘অপমানিত’ রূপা প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়েছে, এ ভাবে তাঁর কাজের রাশ টেনে ধরা হলে তিনি দল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববেন। তাঁর অভিমান, তিনি দলের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য চাননি। নিজের উদ্যোগে এবং অর্থে ত্রাণ সংগ্রহ করে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন। দল তাঁর এই কাজের ফায়দা নিতে পারত। তা না করে সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠী রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন নেতারা!
রূপা-রাহুল সংঘাত বন্যার আবহে আখেরে মমতার সুবিধাই করে দিয়েছে। নবান্নে এ দিন সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। বৈঠকের পরে তিনি বলেন, ‘‘সরকারকে তাদের কাজ ঠিকমতো করতে দিন। এটা নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়! মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাহায্য করাই আমাদের কাজ।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘যখন কোনও দুর্যোগ আসে, দুর্ভোগ আসে, আমরা অনেক সময়ে কাজের চেয়ে অকাজ করে ফেলি বেশি! বন্যাদুর্গত মানুষদের দু’মুঠো ভাত দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে। সেখানে গিয়ে অযথা দুর্গত মানুষদের বিরক্ত করবেন না। সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেন না।’’ এই আবেদনের পাশাপাশিই দুর্যোগে মৃতদের পরিবারপিছু চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বস্তুত, দুর্যোগের সময়ে যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই চেষ্টা থাকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের জনসংযোগ বাড়ানোর। রূপাও তা-ই করেছিলেন। বিধানসভা ভোট যখন ধীরে ধীরে আসন্ন, সেই সময়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ আরও বাড়বে, তাতেও সন্দেহ নেই! এমতাবস্থায় ত্রাণের দায়িত্ব সরকারেরই বলে জানিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আসলে জনসংযোগের সুযোগ কেড়ে নিতে চাইছেন বলেই মনে করছেন বিরোধী শিবিরের নেতা-নেত্রীরা। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও ত্রাণ সব জায়গায় পর্যাপ্ত নয় বলেও তাঁদের অভিযোগ।
দলের বিরুদ্ধে মুখ না খুললেও মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে অবশ্য ক্ষোভ গোপন করেননি রূপা। তাঁর কথায়, ‘‘উনি যেমন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যটা তেমন আমাদেরও। দুর্গত মানুষের পাশে কোথায় দাঁড়াতে যাব না যাব, সেটা কি উনি বলে দেবেন? রাজনীতি আমরা নয়, উনিই করছেন!’’ রূপার আরও মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী রাজকোষ থেকে যে ত্রাণ দেবেন, সেটা জনগণেরই টাকা। আমরা কিন্তু নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য দিচ্ছি!’’
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, ত্রাণ নিয়ে বিরোধীরা নয়, দলবাজি করছে শাসক দলই। তাঁর কথায়, ‘‘কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, এ ব্যাপারে ওঁর কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! টাস্ক ফোর্স হোক আর যা-ই হোক, বহু জায়গায় সরকারি ত্রাণ পৌঁছয়নি। ত্রাণ চাইতে গিয়ে মিনাঁখায় তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের গুলিতে মারা গিয়েছেন আমাদের এক জন। তার মধ্যে উনি আবার এ সব বলছেন!’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে ত্রাণের কথা বলে উনি তো যে কোনও জায়গায় যেতেন। তখন ম্যান-মেড বন্যার কথা বলতেন!’’
রূপার দলেরই বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, রাজনীতি না-করার কথা বলে আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অন্যদের অধিকার কি কেড়ে নিতে চাইছে সরকার? তাঁর কথায়, ‘‘রাজনৈতিক দল বা অন্য যে কোনও অরাজনৈতিক সংগঠন বিপন্ন মানুষের কাছে ত্রাণ নিয়ে যেতেই পারে। এই অসাধারণ সরকারের এটা আরও একটা অসাধারণ কাণ্ড! আর্তদের পাশে দাঁড়ানোর সংবেদনশীলতার উপরেই আঘাত হানতে চাইছে এই সরকার!’’ বন্যা পরিস্থিতির কবলে থাকা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘সরকার ত্রাণ দেবে, এটা সরকারের কর্তব্য। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারের বাইরেও একটা বিরাট জগতের মানুষ সাধ্যমতো সাহায্য করেন, এটা প্রাকৃতিক ঘটনা। একে রাজনীতি বলে না! মানবিকতা বলে!’’ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কোথাও ত্রাণ নিয়ে যেতে কাউকে নিষেধ করা হয়নি। কিন্তু রাজ্য সরকারের আবেদন, ত্রাণ দিতে গিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা যেন কেউ না করেন।
পার্থবাবুর কথায়, ‘‘কিছু জিনিস নিয়ে গেলাম, ছবি তুললাম, হৈচৈ করলাম— এই জিনিসটা না-করতে আবেদন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের লোকজন গেল আর আসল কাজটা পণ্ড হল, দুর্যোগের সময়ে এমন ঘটনা কাঙ্খিত নয়।’’ কিন্তু তাঁরা তো অতীতে ভূমিকম্প থেকে শিলাবৃষ্টি, খরা থেকে বন্যা— সর্বত্র ত্রাণের জন্য যেতেন? পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘আমরা সরকারের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করতাম। এখানে সরকারই যা করার করছে। যেখানে যাওয়ার মন্ত্রীরা যাচ্ছেন। তৃণমূল দল হিসাবে কিন্তু কিছু করছে না এখন।’’
মুখে এমন আবেদন করলেও বিধানসভা ভোটের আগের বছরে রাজনৈতিক তাগিদ কতটা প্রবল, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এ দিনের ঘোষণাতেই তা স্পষ্ট। তিনি জানান, সোমবার অশোকনগরের কাজলায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার কথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতার। যেখানে গিয়ে বাধা পেতে হয়েছিল রূপাকে! নাছোড় বিজেপি-ও অবশ্য আজ, শনিবারই হাবরা-অশোকনগরের ঝড়-বিধ্বস্ত এলাকায় অসীম সরকারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, ত্রাণ নিয়ে রাজনীতির বাজার এখন সরগরম!