—ফাইল চিত্র।
সারদাকাণ্ডে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে এসএসকেএম হাসপাতালে কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। হাসপাতাল কর্মীরা জানিয়েছিলেন, দিন-রাত বেজার মুখেই থাকতেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী ‘হাই-প্রোফাইল’ অভিযুক্ত মনোরঞ্জনা সিংহ।
দিন পনেরো আগে হঠাৎ সকাল থেকেই তাঁকে ফুরেফুরে মেজাজে দেখে খানিক অবাক হয়েছিলেন ওই কর্মীরা। ওই দিনই দুপুরে কার্ডিওলজি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুল্যান্স আসার খবর শুনে বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়েছিলেন মনোরঞ্জনা। তার পর তড়িঘড়ি ব্যাগপত্তর গুছিয়ে সটান অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে পড়েন তিনি। কার্ডিওলজি বিভাগের এক কর্মী বললেন, ‘‘প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, উনি বোধ হয় জেলেই চলে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন জেগেছিল, জেলে গেলে এত ফূর্তি হবে কেন! পরে আসল কারণটা বুঝতে পারলাম। উনি সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে থাকার অনুমতি পেয়েছেন।’’ সিবিআইয়ের কর্তারা জানিয়েছেন, গ্রেফতার হওয়ার পরেই মনোরঞ্জনা লকআপে এসি মেশিন বসানোর বায়না জুড়েছিলেন। পরে তাঁকে অসুস্থতার জন্য এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে তিনি ভর্তি হয়েছেন একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আটতলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বিলাসবহুল কেবিনে।
সিবিআই সূত্রের খবর, প্রথমে এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের ৪ নম্বর কেবিনে মনোরঞ্জনাকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের কেবিনে এসি মেশিন নেই। এ নিয়ে অনেক বার অনুযোগ করছেন তিনি। হাসপাতালে তাঁর জন্য আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা করার দাবিও তুলেছিলেন। মনোরঞ্জনার বক্তব্য ছিল, সরকারি হাসপাতালের এই পরিবেশের সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সিবিআই আফিসাররা জানিয়েছেন, জেরার সময়েও মনোরঞ্জনা বারবার জানিয়েছেন, যে বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় তিনি অভ্যস্ত, তাতে এই পরিবেশে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আইনে এ রকম কোনও ব্যবস্থা না থাকায় তাঁর এই সব দাবি মানা যায়নি বলে জানিয়েছিলেন সিবিআই অফিসারেরা।
তা হলে এখন কী করে সরকারি হাসপাতাল থেকে বিলাসবহুল বেসরকারি হাসপাতালে গেলেন মনোরঞ্জনা? সিবিআই অফিসারেরা জানিয়েছেন, গত ৭ নভেম্বর মনোরঞ্জনা আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারকের কাছে একটি আর্জি পেশ করে জানান, তাঁর উন্নতমানের চিকিৎসার প্রয়োজন, যা সরকারি হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি নিজের খরচে কোনও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চান। ওই দিন সিবিআই তাঁকে ফের হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানায়নি। তাই আদালত মনোরঞ্জনার জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। পরে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত আর্জিও মঞ্জুর করে কোর্ট। নিজের খরচে চিকিৎসা করানোর বিষয়ে সিবিআইয়ের পক্ষ থেকেও কোনও আপত্তি জানানো হয়নি। মনোরঞ্জনার আইনজীবী বিপ্লব গোস্বামী বলেন, ‘‘সব কিছু আইনের পথেই হয়েছে।’’
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১১ নভেম্বর একবালপুরের ওই হাসপাতালে ভর্তি হন মনোরঞ্জনা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তিনি যে কেবিনে রয়েছেন তার দৈনিক ভাড়া ৮ হাজার টাকা। তা ছাড়া দৈনিক আরও ৬ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে রোজ প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ করে ওই কেবিনে থাকছেন মনোরঞ্জনা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ২০০ বর্গফুটের ওই কেবিনে রয়েছে সোফাসেট ও টিভি।
এ দিন আটতলার ওই কেবিনের সামনে গিয়ে দেখা গেল, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সামনে পুলিশ পাহারা। তবে অভিযুক্তর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন অনেকেই। সিবিআই সূত্রের খবর, জেল হেফাজতে থেকেও পরিজনদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করছেন মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন পত্নী। সিবিআইয়ের দাবি, হাসপাতালের কাছেই একটি হোটেলে এসে উঠেছেন তাঁর আত্মীয়রা।
কী চিকিৎসা হচ্ছে ওই হাসপাতালে? আদালতে দাখিল করা নথি অনুয়ায়ী, মনোরঞ্জনার হৃদ্যন্ত্রে সমস্যা রয়েছে। সঙ্গে উচ্চ-রক্তচাপ, ইউরিক অ্যাসিড ও ডায়াবেটিসজনিত সমস্যাও আছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এখন উচ্চ-রক্তচাপজনিত অল্প সমস্যা ছাড়া বাকি সব কিছু নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
মনোরঞ্জনার প্রাক্তন স্বামী মাতঙ্গ সিংহও সারদাকাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছেন। প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর জামিনের আবেদনও খারিজ করে দিয়েছে। সিবিআই সূত্রের
খবর, মাতঙ্গ সিংহের কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনও জেল হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। অন্য দিকে মনোরঞ্জনার জন্য পৃথক ব্যবস্থা। অনেকটাই রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্রের মতো। মদনও জেল হেফাজতে থাকাকালীন এসএসকেএমের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ছিলেন। সিবিআইয়ের এক অফিসার বলেন, ‘‘মদনের সঙ্গে মনোরঞ্জনা ফারাক একটাই। মদন সরকারি খরচে সরকারি হাসপাতালে রাজার হালে ছিলেন। আর মনোরঞ্জনা নিজের খরচে তোফা আরামে রয়েছেন।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েও মাতঙ্গের কপালে অবশ্য এর কোনওটাই জোটেনি।’’