তাদের পরিদর্শনের সময়ে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘ভুয়ো’ চিকিৎসক-শিক্ষকদের উপস্থিতি বন্ধ করতে এ বার ব্যবস্থা নিচ্ছে ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)।
শিক্ষক-চিকিৎসকদের নিয়ে কিছু নতুন নিয়ম জারি করেছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৈরি এমসিআইয়ের ‘ওভারসাইট কমিটি’। তাদের নির্দেশ, মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক-শিক্ষকদের নাম, ঠিকানা, নিয়োগ-বদলির তারিখ, রেজিস্ট্রেশন, কখন কলেজে ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন, কবে ছুটি নিচ্ছেন, কোন বর্ষের ছাত্রদের কী পড়াচ্ছেন, তাঁদের হাজিরার প্রাত্যহিক হিসেবের মতো খুঁটিনাটি তথ্য দিনের-দিন কলেজের ওয়েবসাইটে তুলে দিতে হবে। মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরিদর্শনের সময় সেই তালিকা তুলে হবে পরিদর্শক দলের হাতে। নতুন নির্দেশ কার্যকর করার জন্য সময়সীমা ছিল ১০ অক্টোবর। কিন্তু রাজ্যের প্রায় কোনও মেডিক্যাল কলেজই ওই তারিখের মধ্যে সব তথ্য ওয়েবসাইটে দিতে পারেনি। তারা এক মাস সময় চেয়েছে। কিন্তু সেই এক মাসের মধ্যেও পুরো কাজ করে ওঠা যাবে কি না, সংশয়ে রয়েছেন অধিকাংশ কলেজ কর্তৃপক্ষ। নতুন নিয়মের দৌলতে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শিক্ষকদের ‘প্রকৃত’ অবস্থা জানা গেলে, এমসিআই তাদের অনুমোদন বাতিল করে দিতে পারে বলে আশঙ্কায় রয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এত দিন এমসিআইয়ের পরিদর্শনের ঠিক আগে মেডিক্যাল কলেজের কর্তারা অন্য জায়গা থেকে শিক্ষক-চিকিৎসক মায় টেবিল-চেয়ার-যন্ত্রপাতি পর্যন্ত পরিদর্শনের জায়গায় তুলে নিয়ে যেতেন। নতুন পদ্ধতিতে এই ‘কনে দেখানো তোড়জোড়’ করায় সমস্যা হবে। কারণ, কমিটি সুপারিশ করেছে, সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে চিকিৎসক-শিক্ষকদের হাজিরার ‘বায়োমেট্রিক’ ছাপ দিতে হবে বা হাজিরা খাতায় সই করতে হবে। সকাল ১০টায় সেই ‘ডিজিটাল’ তথ্য বা খাতা চলে যাবে মেডিক্যাল কলেজগুলির অধ্যক্ষ বা ডিন বা রেজিস্ট্রারের কাছে। তিনি তাতে সই করে সাড়ে ১১টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ফেরত পাঠাবেন। দীর্ঘ মেয়াদে সে তথ্য হাতে থাকবে এমসিআইয়ের।
সরকারি হোক বা বেসরকারি, এত দিন নিজেদের ওয়েবসাইটে কেবল কোন বিভাগে কোন চিকিৎসক রয়েছেন— ছেপেই দায় সারতেন ওই সব মেডিক্যাল কলেজ-কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসক-শিক্ষকদের কে, কখন ঢুকছেন-বেরোচ্ছেন, কোন বিষয়ে কোন বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন—এই সব তথ্য জানানোর দায় ছিল না। তাই নতুন নিয়ম মানার কথা ভেবে তটস্থ অনেকে।
স্বাস্থ্য-কর্তাদের অনেই মানছেন, জেলার মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে শনি-রবিবার হলেই দল বেঁধে শিক্ষক-চিকিৎসকেরা কলকাতায় আসেন। ফেরেন সোমবার। ‘আউটডোর’-এ বা পড়ানোর দায়িত্বও তাঁরা এমন ভাবে ভাগ করে নেন, যাতে কাউকে সপ্তাহে দু’-তিন দিনের বেশি কাজ করতে না হয়। সেই পদ্ধতি আর চলবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান স্বাস্থ্য-কর্তারা।
অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে আবার অনেক স্থায়ী চিকিৎসকই খাতায়কলমে রয়েছেন। তাঁরা মোটা মাইনে পান, কিন্তু থাকেন অন্যত্র। ক্লাস করতে আসেন কখনও-সখনও। মূলত এমসিআইয়ের পরিদর্শনের আগে তাঁদের ডেকে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ। মেডিক্যাল কাউন্সিলের নতুন নির্দেশের পরে এ ভাবে কাজ চালানোয় সমস্যার হবে। বর্ধমানের এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘কলেজ চালাতে গেলে শিক্ষক-চিকিৎসকদের সুবিধা-অসুবিধাও মাথায় রাখতে হয়। নতুন নির্দেশ মানতে গেলে সমস্যা হবে।’’
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এমসিআইয়ের নতুন নির্দেশ মূলত বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য। কারণ, দেশের অসংখ্য বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি অস্থায়ী শিক্ষক-চিকিৎসক নিয়ে চলছে। তাঁরা আদৌ মেডিক্যাল কলেজে থাকেন না বা ক্লাস করান না। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে তা হয় না।’’
তাই কি? ‘ওভারসাইট কমিটি’র অন্যতম সদস্য বিনোদ রাইয়ের বক্তব্য, সরকারি এবং বেসরকারি—দু’ধরনের মেডিক্যাল কলেজেই বেনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হাতে অনেকগুলি পন্থা রয়েছে যা দিয়ে ঠিকঠাক তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করা যাবে। সবটা ভাঙছি না।’’ এক ধাপ এগিয়ে এমসিআই-য়ের সচিব রিনা নায়ার জানান, শিক্ষক-চিকিৎসকের সংখ্যায় কারচুপি আটকাতে ওয়েব মারফত দেশের সব মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে এমসিআই-কে জোড়া হচ্ছে। এমন ব্যবস্থা হবে, যাতে দিল্লিতে বোতাম টিপে যে কোনও মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক-চিকিৎসকের প্রকৃত সংখ্যা, তাঁরা কে কী করছেন তা জানা যাবে। প্রত্যেক শিক্ষক-চিকিৎসকের একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর থাকবে। ফলে, নিয়ম ভাঙা কঠিন হবে। রিনাদেবীর সংযোজন: ‘‘এই তো সবে শুরু।’’