Michael Madhusudan Dutta

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে...

এ যুগে রামভক্তদের দলবল বলতে অন্য ব্যঞ্জনা। এই ভোটের বছরে বঙ্গজীবনের আনাচে কানাচে তাঁদের দাপাদাপিও প্রকট। কিন্তু বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্রের পরে মাইকেলের জন্মদিনে তাঁর ধারে-কাছেও সেই ‘রামভক্তদের’ দেখা গেল না।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০৭:০৬
Share:

মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধি। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

রামকে ছেড়ে রাক্ষসদের প্রতি পক্ষপাতের জন্য জীবদ্দশায় কম তোপের মুখে পড়েননি তিনি। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রকাশের সময়ে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে অবিচল মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেখানে তিনি লিখছেন, ‘আই ডেসপাইজ় রাম অ্যান্ড হিজ় র‌্যাব্‌ল। বাট দ্য আইডিয়া অব রাবণ এলিভেটস অ্যান্ড কিন্ড্‌লস মাই ইম্যাজিনেশন’ (রাম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের দেখতে পারি না! কিন্তু রাবণের ভাবনায় আমার কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়)!

Advertisement

এ যুগে রামভক্তদের দলবল বলতে অন্য ব্যঞ্জনা। এই ভোটের বছরে বঙ্গজীবনের আনাচে কানাচে তাঁদের দাপাদাপিও প্রকট। কিন্তু বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্রের পরে মাইকেলের জন্মদিনে তাঁর ধারে-কাছেও সেই ‘রামভক্তদের’ দেখা গেল না। সোমবারই ১৯৯ বছরে পা দিয়েছেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-এর কবি। তবু বঙ্গভাণ্ডারের ‘বিবিধ রতন’ নিয়ে আগ্রহের দিনকালে মধু-কবির জন্মদিনটি নিচু তারেই বাঁধা থাকল।

মল্লিকবাজারে মাইকেলের সমাধি-সৌধে মালা দিতে গিয়েছিলেন মুষ্টিমেয় ক’জন প্রবীণ। সেখান থেকে ফেরার মুখে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাক্তন সম্পাদক তথা উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশারদ শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় হাসলেন, ‘‘বিজেপি তো নয়ই, কোনও রাজনৈতিক দলই মাইকেলকে সহজে হজম করতে পারবে না।’’ রাজনারায়ণকে লেখা মাইকেলের আরও একটি চিঠির কথা বলছিলেন শক্তিসাধনবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘উনি কাব্যচর্চার সময়ে সব রকমের ধর্মীয় গোঁড়ামি বাদ দিতে বলেছেন। রাবণ ওঁর ‘গ্রেট ফেলো’, মেঘনাদ ‘ফেভারিট ফেলো’! মেঘনাদের হত্যার বর্ণনা লেখার সময়ে অশ্রুতে ভাসার কথাও লিখেছেন মাইকেল। বিজেপি ঠিকই বুঝেছে মাইকেলকে আত্মসাৎ করা অসম্ভব।’’

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাঙালি মন জয়ে রবীন্দ্র-কবিতা আকছার আওড়ে থাকেন। উনিশ শতকের অনামী কবি মনোমোহন বসুকেও তিনি উদ্ধৃত করেছেন। তবে মাইকেলের নাম এখনও শোনা যায়নি তাঁর মুখে। মেঘনাদ বধ কাব্যে মেঘনাদ-জায়া প্রমীলা বলছেন, ‘আমি কী ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে’। বীরবাহুর মৃত্যুর পরেও বলা হচ্ছে ‘দেশবৈরী নাশে যে সমরে, শুভক্ষণে জন্ম তার’! পাঠক জানে, দেশবৈরী এখানে রামচন্দ্র ও তাঁর দলবল। ‘‘এ যুগে রামকে দেশবৈরী বা ভিখারী বলা কবির ঘোর বিপদ হতে পারত’’, শঙ্কায় ফিল্ম স্টাডিজ়ের শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও।

১৯৫০-এ মধু বসুর ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে নামভূমিকায় ছিলেন উৎপল দত্ত। মঞ্চে উৎপলের ‘দাঁড়াও পথিকবর’, গৌতম হালদারের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ও বাঙালির মধুসূদন-চর্চার স্মারক। ‘‘সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ বা ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’-য় প্রান্তিক বাগদির জীবনেও রামের গল্পের ছায়া পড়েছে। তবু রামায়ণকে অন্য চোখে দেখায় মাইকেলের বিরাট প্রভাব।’’— বলছেন সঞ্জয়। বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘ভারতীয় সাহিত্যের ৮০% রামায়ণ, মহাভারতের অনুসরণে। মাইকেল কেন ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ লিখে অচ্ছুৎ হবেন!’’ সদ্য সুভাষ-জয়ন্তীতেও ‘নেতাজির স্বপ্নে’র সঙ্গে তাঁর আত্মনির্ভর ভারতের ভাবনাকে মিলিয়েছেন মোদী। শক্তিসাধনবাবুর মতে, ‘‘চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলায় মিলটনের মাপের অমিত্রাক্ষর ছন্দ লেখা মধুসূদনের আত্মপ্রত্যয়ও কিন্তু কম নয়। কিন্তু মাইকেলের কাছে রাবণ পুরুষকার, রাম দৈবীবাদের প্রতীক। এটাই মুশকিল।’’

এ বার চিত্রতারকা প্রসেনজিতের তরফে মধুকবিকে ফেসবুক শ্রদ্ধার্ঘে ভুল করে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছবি চলে এসেছিল। ক্ষমা চেয়ে তা শুধরোন হয়। ২০১২-তে রাজ্যের অনুষ্ঠানেও এক বার তরুণ রবীন্দ্রনাথের ছবি ব্যবহৃত হয়েছিল। এ দিন শ্রদ্ধা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পোস্ট, মাইকেল মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। তবে ছক-ভাঙা বেপরোয়া জীবনের মাইকেলকে নিয়ে শাসক শিবিরও অপেক্ষাকৃত নিরুত্তাপ।

মেঘনাদ বধ কাব্যের কবি তাই জন্মদিনে অনন্য এবং একলা থেকে গেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন