সৈকতে স্বাদের টানে বিষের ফাঁদ

বিকেল হলেই ভিড় বাড়ে সৈকতে। বেলুন, ভেঁপু, ঝিনুকের মালার পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানি। দলে দলে হাজির হয় ঠেলা গাড়িও, কাচের শো-কেস পিঠে নিয়ে।

Advertisement

সুব্রত গুহ

দিঘা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪০
Share:

রং মেশানো মুরগির মাংস ও মাছ বিক্রি হচ্ছে সৈকতের ধারের দোকানে। সোহম গুহর তোলা ছবি।

বিকেল হলেই ভিড় বাড়ে সৈকতে। বেলুন, ভেঁপু, ঝিনুকের মালার পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানি। দলে দলে হাজির হয় ঠেলা গাড়িও, কাচের শো-কেস পিঠে নিয়ে। ভিতর থেকে উঁকি দেয় ইলিশ, পমফ্রেট, ভেটকি, চিংড়ি, কাঁকড়া এমনকী মশলা মাখানোর মুরগির ‘টাটকা’ ঠ্যাঙও। লাল-লাল, ঝাল-ঝাল সে সব পদের লোভ সমুদ্রের লোনা হাওয়ায় বেড়ে যায় আরও কয়েকগুণ। দোকানিও জোরে হাঁকেন ‘সমুদ্রের টাটকা মাছ’।

Advertisement

‘টাটকা’ মাছ যে অন্তত সাত দিনের পুরোন, তা অবশ্য স্বীকার করলেন দিঘা সৈকতের এক ব্যবসায়ী। আর কী ভাবে তৈরি হয় অমন সুন্দর লালচে পদ, শুনলে হাড় হিম হয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওল্ড দিঘার ওই ব্যবসায়ীর সাফ কথা, ‘‘রোজ কি অত মাছ বিক্রি হয়ে যায় নাকি? তাই রাসায়নিক মিশিয়ে টাটকা করে রাখতেই হয়।’’

কেমন সেই প্রক্রিয়া? বিক্রেতা জানালেন, বাজার থেকে মাছ কিনে কেটেকুটে ফর্মালিন মেশানো জলে ডুবিয়ে নেওয়া হয়। যাতে বিক্রি না-হলেও মাছে পচন না-ধরে। কম করে একসপ্তাহ টিঁকিয়ে রাখা যায় এ ভাবে।

Advertisement

তবে কি বাসি মাছ ভাজাই খাচ্ছেন আপনি? তা কী করে হয়?

ক্রেতারা বলছেন দিব্যি তো চোখের সামনে বেসনে ডুবিয়ে গরম গরম ভেজে দিচ্ছে! সেখানেও দিব্য কারিগরি। বিক্রি না-হওয়া ভাজা মাছের উপরে থাকা বেসনের চামড়া রাতেই তুলে ফেলেন বিক্রেতা। তারপর ভিতরের মাছের পুর আরও একবার ফর্মালিনে ডুবিয়ে নেওয়াও হয়। পরের দিন ক্রেতার সামনে বেসনের প্রলেপে ডুবিয়ে নিয়ে ফের ভেজে দেওয়া হয় বাসি মাছ— লোভনীয় চিংড়ি ফ্রাই কি কাঁকড়ার রোস্ট।

তবে অতকিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্রেতার স্থান হয় হাসপাতালে। বেড়াতে এসে বিড়ম্বনায় পড়া পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে রাজ্যের জনপ্রিয় সৈকতগুলিতে। সম্প্রতি এ ভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়া কয়েকজন পর্যটককে দিঘা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। তাতেও টনক নড়েনি প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের।

দিঘার প্রবীণ বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রাক্তন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ মিশ্রের কথায়, “ইদানীং মাছের পচন ঠেকাতে আর খাবারের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে রাসায়নিক রং ও বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই পেটের অসুখে ভুগছেন পর্যটকরা। বেড়াতে এসে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, প্রাথমিক ভাবে পেটের অসুখ হলেও, এই সব রাসায়নিকের প্রভাবে ভবিষ্যতে স্নায়ুরোগেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

স্থানীয় সূত্রে খবর, এমন অস্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক মাছ ও খাদ্য সামগ্রী বিক্রির ভ্রাম্যমান দোকানের সংখ্যা ওল্ড দিঘা ও নিউ দিঘা মিলিয়ে ৫০টির বেশি। অভিযোগ, এদের বেশিরভাগেরই কোনও ফুড লাইসেন্স নেই। অথচ, খাদ্যবস্তু বিক্রি করতে গেলে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ প্রশাসনের উদাসীনতায় বাড়ছে এই অসাধু ব্যবসা। এ দিকে স্বাস্থ্য দফতরেও হাঁড়ির হাল। পূর্ব মেদিনীপুরের ২৫টি ব্লকের প্রতিটিতে এবং গোটা জেলার জন্য একজন মোট ২৬ জন খাদ্য সুরক্ষা আধিকারিক থাকার কথা। রয়েছেন মাত্র একজন। ফলে ‘ফুড লাইসেন্স’ দেওয়া বা খাদ্যের গুণগত মান পরীক্ষা— কোনটাই করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জেলা স্বাস্থ্যদফতর সূত্রে বলা হয়েছে।

দিঘার পদিমা-১ পঞ্চায়েতের প্রধান মণীন্দ্র দত্ত অবশ্য সব দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘এক সময় ব্লক ‘স্যানেটারি ইন্সপেকটর’ ছিলেন। সেই পদ উঠে গিয়েছে। নজরদারির ক্ষমতা এখন আর পঞ্চায়েত বা ব্লকের হাতে নেই। সবটাই করবে জেলা স্বাস্থ্যদফতর।” কাঁথির সহকারি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক চন্দ্রশেখর মাইতিও কর্মী সঙ্কটের দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘খাদ্য সুরক্ষা অভিযান চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তবে দিঘার সৈকতে ভেজাল ও বাসী খাদ্যদ্রব্যের বিক্রি আটকাতে বিশেষ নজরদারি অভিযান চালানোর চিন্তাভাবনা করছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন