মাস্ক ব্যবহারের রীতি জানেন না অনেকেই। ছবিটি প্রতীকী নিজস্ব চিত্র।
করোনাভাইরাস আটকানো যায় মাস্কে। এটা জানার পরেই মাস্ক কেনার হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু কোন মাস্ক কাজের আর মাস্ক ব্যবহারের পরে তা কী করতে হবে তা জানা নেই বহুজনের। ফলে সেইসব মাস্কের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। তার পর তা নিয়ম মেনে নষ্ট হচ্ছে না। নতুন ধরনের বিপদের সৃষ্টি হচ্ছে। জেলায় জেলায় একই দৃশ্য।
কাঁথিতে প্রায় সমস্ত ওষুধের দোকানে ইদানীং মাস্ক বাড়ন্ত। কেউ কেউ রুমাল এবং তোয়ালে দিয়ে মাস্ক তৈরি করে ব্যবহার করছেন। অধিকাংশই একবারই মাস্ক কিনছেন। তার পর সেই মাস্ক ব্যবহার করেই চলেছেন। তবে রাস্তাঘাটে বা ডাস্টবিনে মাস্ক বিক্ষিপ্ত ভাবে দু’একবার পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে।
মেদিনীপুর শহরেও একই ছবি। করোনা আতঙ্কের জেরে অনেকেই এখন মাস্ক কিনছেন। পরছেন। কিন্তু অনেকে মাস্কের সঠিক ব্যবহার করছেন না। ব্যবহারের পরে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলছেনও না। যত্রতত্র মাস্ক ফেলছেন। ফলে, ব্যবহৃত মাস্ক থেকেও সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা এ বিষয়ে বলেছেন, ‘‘মাস্কের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই সচেতন নন। আমরা মাস্কের ব্যবহারের বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সচেতনতা শিবিরগুলিতে মাস্কের ব্যবহারের বিষয়টিও জানানো হচ্ছে।’’ জেলার এক স্বাস্থ্য আধিকারিক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘যত্রতত্র নয়, নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ব্যবহৃত মাস্ক ফেলা উচিত। একটি মাস্ক দ্বিতীয়বার ব্যবহার করাও ঠিক নয়।’’ তিনি জানাচ্ছেন, মাস্ক যত্রতত্র ফেললে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। শহর, শহরতলির ইতিউতি এখন মাস্ক পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে রাস্তার পাশে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে মাস্ক পরার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারঙ্গী জানাচ্ছেন, ‘‘মাস্ক ব্যবহারের কিছু বিধিনিয়ম রয়েছে। সে সব না মেনে, যেমন তেমন ভাবে মাস্ক পরলে কিন্তু কোনও উপকার হবে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সুস্থ মানুষদের সব সময়ে মাস্ক পরে থাকার দরকারও নেই। বিশেষ করে ঘরের মধ্যে থাকলে এবং সুস্থ মানুষদের সঙ্গে বসবাস করলে।’’ অনেকে মাস্ক পরার পর বারবার তাতে হাত দেন। জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, এটা একেবারেই অনুচিত। সৌম্যশঙ্করের কথায়, ‘‘মাস্ক পরার পর তাতে বারবার হাত দিলে মাস্কে আটকে থাকা জীবাণু হাতে লেগে যাবে। সেই হাত থেকেই নাক-মুখের মাধ্যমে অসুখ ছড়িয়ে যেতে পারে।’’ অনেকে সামনের দিক ধরে টেনে মাস্ক খোলেন। এতেও মাস্কের জীবাণু হাতে লেগে যায়। সৌম্যশঙ্করের কথায়, ‘‘পিছন দিক থেকে মাস্কের দড়ি বা ইলাস্টিক ব্যান্ড টেনে মাস্ক খোলা উচিত।’’ জেলার এক স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘অনেকে একই মাস্ক দিনের পর দিন পরেন। এটাও একেবারে অনুচিত। একই মাস্ক একদিনের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। মাস্ক ভিজে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা বদল করতে হয়।’’
ঘাটাল মহকুমা জুড়ে মাস্কের এমনিতে মাস্কের অভাব। তবে কেউ কেউ মাস্ক ব্যবহার করছেন। এঁদের অনেকের মুখে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ব্যবহৃত মাস্ক নয়। বাজারে অমিল থাকায় বাধ্য হয়ে যে কোনও মাস্ক ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন ঘাটালের বাসিন্দাদের একাংশ। তবে ব্যবহৃত মাস্ক ফেলা নিয়ে ঘাটালে এখনও অবধি তেমন কোনও অভিযোগ সামনে আসেনি। প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির তরফে নানা ভাবে সচেতনতা করা হচ্ছে। মাস্কের ব্যবহারের পর সেগুলি যাতে
রাস্তায় বা জনবহুল জায়গায় না ফেলা হয়, তার প্রচারও চালাচ্ছে প্রশাসন।
ঝাড়গ্রাম জেলার ওষুধের দোকানগুলিতে এন-৯৫ মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে বাজার থেকে সাধারণ মাস্ক কিনে দেদার পরছেন জেলাবাসী। একই মাস্ক বার বার পরা হচ্ছে। তাতে অন্য সংক্রমণের শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। শহরের একটি ওষুধের দোকানের মালিক সায়ন্তন রায় নিজে ফার্মাসিস্ট। তিনি জানাচ্ছেন, তাঁর দোকানে খান দশেক এন-৯৫ মাস্ক ছিল। করোনার আতঙ্ক ছড়াতেই কয়েকদিন আগে একই দিনে সবগুলি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তবে ওই মাস্কও দু’রকম হয়। ওয়াশেবল মাস্ক এবং সিঙ্গল ইউজ মাস্ক। ওয়াশেবল মাস্ক জীবানুনাশক দিয়ে তিন-চার বার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সিঙ্গল ইউজ মাস্ক নির্দিষ্ট কয়েক দিন পরে ব্যবহার যোগ্য থাকে না। বাতিল মাস্ক নষ্ট করার পদ্ধতিও অনেকে জানেন না। বিক্রির সময়ে তিনি বলে দেন। তা-ও ডাস্টবিনে মাস্ক পড়ে থাকে।
ঝাড়গ্রামের সিএমওএইচ প্রকাশ মৃধা বলেন, ‘‘যাঁরা এই পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রান্ত বিশেষ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে যুক্ত রয়েছেন, তাঁরা মাস্ক পরবেন। কিন্তু সর্বসাধারণের মাস্ক পরা খুব জরুরি নয়। কারণ, এই সময়ে সমাজিক দূরত্ব রাখতে বলা হচ্ছে। এটা ড্রপলেট ইনফেকশন। সুতরাং এক মিটার বা তার সামান্য বেশি দূরত্ব বজায় রাখলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভাইরাস তো আরও জায়গায় থাকতে পারে। সেই কারণেই বারবার হাত উপযুক্ত পদ্ধতিতে ধুতে বলা হচ্ছে। সাধারণের বেশিরভাগই মাস্কের ব্যবহার বিধি জানেন না। সেই কারণে মাস্ক এড়িয়ে চলাই ভাল। না হলে অন্য বিপত্তি হতে পারে।’’ সিএমওএইচ জানাচ্ছেন, ব্যবহার শেষে বাতিল মাস্ক পুড়িয়ে ফেলাই ভাল।
গড়বেতা, গোয়ালতোড়, চন্দ্রকোনা রোড, এই তিনটি ব্লকে এন-৯৫ মাস্ক খুব কমই ব্যবহার হচ্ছে। বেশিরভাগই কাপড়ের মাস্ক, ব্যবহৃত হচ্ছে সার্জিকাল মাস্কও। ভাইরাস প্রতিরোধে যেসব মাস্ক ব্যবহার হয়, সেসবের আকালের জন্যই সাধারণ মাস্কেই ভরসা রাখছেন এই তিন ব্লকের মানুষ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্কগুলিকে নষ্ট করার জন্য ব্লক প্রশাসন গুলি থেকে প্রচার করা হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই এইসব মাস্ক নষ্ট করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। অনেকসময় যেখানে সেখানেও ফেলা হচ্ছে। অনেক পরিবারে আবার একটা মাস্কই ব্যবহার করছেন পরিবারের সবাই। বাইরে গেলে পড়ে নিচ্ছেন যে কেউ। চিকিৎসকেরা বলছেন, এটা একেবারেই অনুচিত। গড়বেতার বিএমওএইচ আশিস মিদ্যা বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক ব্যবহার করে তা নষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, প্রচারও হচ্ছে, অনেকে মানছেন। আমরা মাস্কের বিষয়টি নজর রাখছি।’’
এগরাতেও একই অবস্থা। প্রয়োজনের তুলনায় মাস্কের যোগান কম থাকায় বেশি দামে সাধারণ মানুষকে মাস্ক কিনতে হচ্ছে। দাম বেশি হওয়ায় প্রতিদিন নতুন করে মাস্ক কেনার সামর্থ্য নেই সাধারণ মানুষের। ফলে একটি মাস্ক জলে পরিষ্কার করে আবার তা ব্যবহার করছেন। এগরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে এক সহকারী আধিকারিক বলেন, ‘‘নিয়মিত নতুন করে মাস্ক বিতরণ করা হয় হাসপাতালের কর্মীদের। ব্যবহৃত মাস্ক হাসপাতালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জায়গায় ফেলা হয়।’’
তমলুক জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সার্জিক্যাল মাস্ক দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের এক আধিকারিক জানান, তাঁদের ব্যবহৃত মাস্ক হাসপাতালের বর্জ্যসামগ্রী ফেলার জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই বর্জ্যসামগ্রী দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তারাই সেগুলি নষ্ট করছে। বাসিন্দাদের অনেকে মাস্ক ব্যবহার করার পরে তা প্যাকেট করে বাড়ির ডাস্টবিনে ফেলছেন। বাড়ির অন্য বর্জ্যের সঙ্গেই তা পুরসভার সাফাইকর্মীরা নিয়ে যাচ্ছে বলেন অভিযোগ। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই মাস্ক ব্যবহারের পর তা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন।
তথ্য সহায়তা: কেশব মান্না, বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী, কিংশুক গুপ্ত, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, গোপাল পাত্র, আনন্দ মণ্ডল