হাসপাতালের ঘরের হাল এমনই। নিজস্ব চিত্র।
দোতলা হাসপাতাল ভবনের ছাদে শিকড় ছড়িয়েছে বট-অশ্বত্থ। ভিতরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে রোগ সারানো দায়। মহিলা বিভাগের ছাদটি যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে— ভয় পান কর্তৃপক্ষ। ঘন ঝোপ ক্রমশ গ্রাস করছে চারপাশ।
এই ছবি ঝাড়গ্রাম কুষ্ঠ হাসপাতালের। জীর্ণ চেহারার খাঁজে খাঁজে ইতিহাস ধরা আছে। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভোলা রায় এবং কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক দেবাদিশরণ চৌধুরীর উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম কুষ্ঠ নিবারণ প্রকল্পের কাজকর্ম শুরু হয়। মূল চালিকা শক্তি ছিল পশ্চিম জার্মানির একটি সংস্থার (জার্মান লেপ্রসি রিলিফ অ্যাসেসিয়েশন)। মিলত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানও। কিন্তু ২০০৫ সালে ভারতকে কুষ্ঠ-মুক্ত ঘোষণা করে কেন্দ্র। তারপরেই অনুদান কমিয়ে দেয় জার্মান সংস্থাটি। কর্তৃপক্ষ জানান, ২০০৬ সাল থেকে নামমাত্র কিছু টাকা আসত। কিন্তু ২০০৯ সালের পরে সেটুকুও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সমস্যা হল, পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে এখনও কুষ্ঠ রোগের জীবানু রয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে সারা দেশে ১লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯.৭৩ জন কুষ্ঠ আক্রান্ত। ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এ রাজ্যের পরিসংখ্যানে রয়েছেন ৯ হাজার নতুন রোগী, ১১ হাজার আক্রান্তের চিকিৎসা চলছে। অথচ, চিকিৎসা পরিষেবার মান কমে গিয়েছে গত এগারো বছরে। কারণ এই সময়ে ধরেই নেওয়া হয়েছিল কুষ্ঠ বলে আর কিছু নেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, জঙ্গলমহলের বিভিন্ন অঞ্চলে কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ রয়েছে। ঝাড়গ্রামের কুষ্ঠ হাসপাতালটিতে এক সময় সব রকমের পরিকাঠামো ছিল। বাড়ি বা়ড়ি ঘুরে রোগী চিহ্নিত করতেন কর্মীরা। চিকিৎসা করতেন ভারতীয় এবং জার্মান চিকিৎসকেরা। ছিল অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থাও। কিন্তু এখন আর কিছুই হয় না। সরকারি উদাসীনতা আর বরাদ্দের অভাবে শিকেয় উঠেছে চিকিৎসা। কেন্দ্রীয় সরকারের সামান্য বার্ষিক অনুদানে চলা কুষ্ঠ নিবারণ প্রকল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে রোগী চিহ্নিতকরণের কাজ। পরিস্থিতি এমনই যে হাসপাতাল চত্বরে প্রশাসনিক ভবনের একাংশ ভাড়া বসিয়ে দিতে হয়েছে। ঝাড়গ্রাম কুষ্ঠ নিবারণ প্রকল্পের সম্পাদক সুকুমার পৈড়া বলেন, “মূলত অর্থাভাবে সংস্কার কাজ বন্ধ। রোগীদের উন্নত পরিষেবা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। সংস্থার ১৭ জন কর্মীকে দীর্ঘদিন নামমাত্র সাম্মানিকের বিনিময়ে কাজ করতে হচ্ছে।’’ অথচ, এখনও সরকারি হাসপাতাল থেকে মাঝে মধ্যে কুষ্ঠ রোগীদের এখানে পাঠানো হয়।
চরম আর্থিক সংকটের জেরে বেসরকারি এই সংস্থাটির প্রশাসনিক ভবনের দোতলাটি পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে পর্ষদের ঝাড়গ্রাম শাখা অফিসটি চলছে। এ ছাড়া হাসপাতাল ভবনের এক তলায় ভাড়াটে বসানো হয়েছে। সংস্থার অতিথিশালাটির একাংশে একটি নার্সারি স্কুলকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অর্থাভাবে সংস্থার অ্যাম্বুল্যান্সটিও পড়ে রয়েছে বেহাল। প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গলমহলে কুষ্ঠ নিবারণে অগ্রণী ভূমিকায় থাকা এই সংস্থাটি রাজ্যের সরকারি সাহায্য থেকে কেন বঞ্চিত?
ঝাড়গ্রাম স্বাস্থ্যজেলার ভারপ্রাপ্ত কুষ্ঠ আধিকারিক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নতুন করে কুষ্ঠ রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সমীক্ষাও চলছে। নতুন করে শহরাঞ্চলে সমীক্ষা শুরু হবে শীঘ্রই। কিন্তু ওই হাসপাতালটি যেহেতু বেসরকারি সংস্থার অধীন, তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’ তবে স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক কটাক্ষ করতে ছাড়েননি, ‘‘তড়িঘড়ি রিপোর্ট দিয়ে কুষ্ঠ-মুক্ত ঘোষণা করে দেওয়া হল দেশকে। বিদেশি সাহায্য আর আসবে কেন?’’