রেললাইন স্বপ্নই! প্রকল্প গিলেছে পান বরজ, জোটেনি চাকরি

নন্দীগ্রাম নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগ কারও অজানা নয়। তাঁর মুখ দিয়েই ঘোষণা হয়েছিল, ক্ষমতায় এলে নন্দীগ্রামে রেল চালু করবেন। প্রায় ৯ বছর আগে কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল দেশপ্রাণ-নন্দীগ্রাম রেলপ্রকল্পের কাজ। কিন্তু কয়েক বছর পর সেই কাজ থমকে যায়।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

তমলুক শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৫২
Share:

নন্দীগ্রাম রেলস্টেশন। পাতাই হয়নি লাইন। একা কুম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে স্টেশন ভবন। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

মাঠের মাঝে সুদৃশ্য বাড়িটা থেকে রঙের প্রলেপ উঠে গিয়েছে। বাড়ির সামনে প্ল্যাটফর্মের উপর ওভারব্রিজ। স্টেশনের অদূরে সার দেওয়া ভগ্নপ্রায় বাড়িঘর। নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে এমনই হাল নির্মীয়মাণ রেল স্টেশনের।

Advertisement

নন্দীগ্রাম নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগ কারও অজানা নয়। তাঁর মুখ দিয়েই ঘোষণা হয়েছিল, ক্ষমতায় এলে নন্দীগ্রামে রেল চালু করবেন। প্রায় ৯ বছর আগে কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল দেশপ্রাণ-নন্দীগ্রাম রেলপ্রকল্পের কাজ। কিন্তু কয়েক বছর পর সেই কাজ থমকে যায়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে ও রাজ্যে পট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু থমকে যাওয়া কাজ আর চালু হয়নি। লোকসভা ভোটে থমকে যাওয়া সেই রেল প্রকল্পকেই হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে তৃণমূল। পাল্টা সুর চড়িয়েছে বিজেপিও। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা নন্দীগ্রামে ভোটের প্রচারে এবার রেলপ্রকল্পই অন্যতম ইস্যু।

প্রায় ১২ বছর আগে নন্দীগ্রামে জমিরক্ষার আন্দোলনে রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল তৃণমূলের। জমি আন্দোলনে ভর করে তৎকালীন রাজ্যের শাসক বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিল বিরোধী তৃণমূল। এরপরে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লোকসভায় ভোটে জিতে কেন্দ্রে ইউপিএ (দ্বিতীয়) সরকারের রেলমন্ত্রী হন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দেশপ্রাণ-বাজকুল থেকে নন্দীগ্রাম পর্যন্ত ১৭.২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণের শিলান্যাস করেন মমতা। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য সব জমিদাতাদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা।

Advertisement

জমি অধিগ্রহণের পরে ঠিকাদার নিয়োগ করে দেশপ্রাণ স্টেশন থেকে নন্দীগ্রাম বাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য মাটি ফেলা ও খালের উপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নন্দীগ্রাম বাজারের কাছে শুরু হয় স্টেশন তৈরি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জমিহারা পরিবারের সদস্যদের অনেকে চাকরি পান রেল দফতরে। ছন্দপতন ঘটে পরের বছর রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর। রেলমন্ত্রক ছেড়ে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার জায়গায় রেলমন্ত্রী হন মুকুল রায়। সেই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু তাল কাটে পরের বছর ইউপিএ (দ্বিতীয়) জোট সরকার ছেড়ে তৃণমূল বেরিয়ে আসার পর।

অভিযোগ, তৃণমূল ইউপিএ (দ্বিতীয়) জোট সরকার ছাড়ার পরে নন্দীগ্রাম রেলপ্রকল্প গতি হারায়। তারপর কেন্দ্রেও পালাবদল ঘটে। তৈরি হয় বিজেপির সরকার। সেই থেকে নন্দীগ্রাম রেলপ্রকল্পের কাজ এক ইঞ্চিও এগোয়নি। থমকে যাওয়া রেলপ্রকল্পকে ইস্যু করে লোকসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামের ভোটারদের ক্ষোভ উসকে দিতে চাইছে তৃণমূল।

নন্দীগ্রাম-১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি মেঘনাদ পালের অভিযোগ, ‘‘বিজেপির আমলে রেল প্রকল্পের কাজ একটুও এগোয়নি। জমিদাতা ১২০০ পরিবারের মধ্যে ৬০০টি পরিবার আগে চাকরি পেলেও বিজেপির আমলে একজনও চাকরি পায়নি। নন্দীগ্রামের মানুষের স্বার্থে রেল দফতরের কাছে বারবার আর্জি জানিয়েও সুরাহা হয়নি।’’ হরিপুর গ্রামের যুবক সুব্রত পড়ুয়া বলেন, ‘‘পান বরজ-সহ ২৪ ডেসিমাল জমি চলে গিয়েছে রেলপ্রকল্পে। চাকরির জন্য সাত বছর আগে খড়গপুরে রেল দফতরে আমার ইন্টারভিউ হয়েছিল। এখনও চাকরি পাইনি.’’

বিজেপির তমলুক জেলা সভাপতি প্রদীপ দাস বলেন, ‘‘আমরাও চাই ওই রেলপ্রকল্পের কাজ শেষ হোক। জমিদাতা পরিবারের লোক চাকরি পাক। কিন্তু নন্দীগ্রামে তৃণমূল যে কর্মসংস্কৃতি আমদানি করেছে তাতে গণতন্ত্র নেই। তাই আগে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। আগামীদিনে নন্দীগ্রামে রেলপ্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। জমিদাতাদেরও চাকরি হবে।’’

রাস্তাঘাট উন্নয়ন, আটশো কোটি টাকার পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প থেকে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, বিদ্যুদয়ন প্রকল্প— রাজ্যে সাফল্যের খতিয়ান এখন তৃণমূলের প্রচারে। সিপিএম নেতা তথা বামফ্রন্টের নন্দীগ্রাম বিধানসভা নির্বাচন কমিটি আহ্বায়ক রামহরি পাত্র বলেন, ‘‘রেল প্রকল্প ও জেলিংহামে রেলের যন্ত্রাংশের কারখানা তৈরির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? বিজেপিও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। নন্দীগ্রামের মানুষ বুঝতে পেরেছে কী তৃণমূল, কী বিজেপি কেউ তাদের পাশে নেই।’’

লোকসভা ভোটের পর নতুন সরকার এলে ট্রেনে কলকাতা যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তব হবে কি না, জমি দাতারা চাকরি পাবে কি না সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে নন্দীগ্রামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন