ঝাড়গ্রাম আদালতে মাওবাদী নেত্রী তারা (বাঁ দিকে)। মেয়ের কথা ভুলেই কাটছে দিন। বিনপুরের রঘুনাথপুরে তারার বাড়িতে (ডান দিকে)।
শুক্রবার বিকেলে একমনে মাটির বাড়ির উঠোন নিকোচ্ছিলেন পূর্ণিমা মুর্মু। কয়েকদিন পরেই ‘বাহা মাঃ মড়েঁ’ পরব। ঠাকুরমণিকে দেখতে গেলেন না কেন? প্রশ্ন শুনে থমকে তাকান একবার। তারপর ফের চোখ কুঁচকে মাটি দিয়ে দালান মসৃণ করতে থাকেন। বিনপুরের রঘুনাথপুর গ্রামের এক চিলতে টিনের চালের এই মাটির বাড়িতেই এক সময় মায়ের সঙ্গে ঘর নিকোনের কাজে হাত লাগাতেন ঠাকুরমণি। আদর করে মা ডাকতেন পাখি। গোটা গ্রামের পাখির চোখ ছিল আয়ত চোখের কিশোরীটি। সেই পাখিই বছর দশেক আগে একদিন বাপ-মা’কে ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন।
পরে পূর্ণিমাদেবী শুনেছিলেন মেয়ে নাকি তাঁর ডাকসাইটে মাওবাদী নেত্রী। নাম হয়েছে ‘তারা’। সে দিন থেকেই অভিমান আর তীব্র ক্ষোভ জমাট বেঁধেছিল বুকে। স্কোয়াডে থাকার সময় মাওবাদী নেতা বিকাশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের খবর শুনেছিলেন লোকমুখে। প্রায় দশ বছর মেয়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না।
এ দিন ঝাড়গ্রাম আদালতে তারাকে তোলা হয়েছে, অথচ যাননি মা। কেন? দ্বিতীয়বার প্রশ্ন শুনে এ বার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন পূর্ণিমাদেবী। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “ও বাড়ি ছাড়ার সময় কী আমাদের অনুমতি নিয়ে গিয়েছিল? কে বলেছিল মাওবাদী হতে? কত মানুষের রক্ত আর অভিশাপ নিয়ে কী সুখের ঘর বাঁধল? কেন যাব অমন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে!”
স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা করেন গালু মুর্মু। হাজার হোক পিতৃস্নেহ। কিন্তু মায়ের মন যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। পেশায় চাষি গালুবাবুর তিন মেয়ের মধ্যে ঠাকুরমণি ওরফে পাখি মেজ। বড় মেয়ে ও সেজ মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট ছেলে বছর একুশের বিশাল মুর্মু উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আর পড়াশোনা করেননি। বাবার সঙ্গে চাষাবাদে দেখাশোনা করেন তিনি। পরিবারের সম্বল বলতে বিঘে দু’য়েক জমি। বাকি সময় খেতমজুরির কাজ।
মেয়ে যে কী ভাবে মাওবাদীদের হাত ধরে ঘর ছাড়ল সেটা আজও বুঝে উঠতে পারেন না গালুবাবু ও পূর্ণিমাদেবী। জানা গেল, স্থানীয় রানারানি স্কুলে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ধেড়ুয়ার কাছে জীবনপুর গ্রামে ঠাকুরমণির বিয়ে দিয়েছিলেন অভিভাবকরা। সাল তারিখ আর মনে নেই। মৃত সন্তান প্রসব করে অসুস্থ হয়ে পড়েন ঠাকুরমণি। শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা-লাঞ্ছনায় জর্জরিত মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন গালুবাবু। তখনও লালগড় আন্দোলন দানা বাঁধেনি। প্রায়ই কিষেণজির নেতৃত্বে মাওবাদীদের লোকজন এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে সংগঠনের মতবাদ প্রচার করতেন। এক অগ্রহায়ণে দূরের গাঁয়ে ধান কাটতে গিয়েছিলেন গালুবাবু ও পূর্ণিমাদেবী। বাড়ি ফিরে দেখেন ঠাকুরমণি নেই। আর ফিরে আসেনি হরিণ চোখের মেয়ে।
গত এপ্রিল মাসের গোড়ায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী দম্পতি বিকাশ ওরফে মনসারাম হেমব্রম এবং তাঁর স্ত্রী তারা ওরফে ঠাকুরমণিকে গ্রেফতার করে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। হুগলি জেলার মগরা চাঁপারুই থেকে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। বিকাশ এখন শালবনি বিস্ফোরণ মামলায় সিআইডি হেফাজতে। গ্রেফতারের পরে কলকাতায় এসটিএফের হেফাজতে থাকাকালীন মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন গালু মুর্মু। বাবার সঙ্গে দিদিকে দেখতে গিয়েছিল বিশালও। যাননি পূর্ণিমাদেবী।
এ দিন শিলদাকাণ্ড-সহ তিনটি মামলার ‘ফেরার’ অভিযুক্ত তারাকে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে তোলা হয়। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে হামলা চালায় মাওবাদীরা। প্রাণ হারান ২৪ জন জওয়ান। ওই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হলেন তারা। মামলাটি এখন মেদিনীপুরের বিশেষ আদালতে বিচারাধীন। সেখানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
২০০৮ সালের ২৬ মে ঝাড়গ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ইএফআর ও পুলিশ কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে একটি একে-৪৭, একটি কার্বাইন এবং এক সাব ইন্সপেক্টরের একটি সার্ভিস রিভলবার লুঠ করেছিল মাওবাদীরা। অভিযোগ, ওই ঘটনায় বিকাশ ও তারা-সহ মাওবাদী স্কোয়াডের ছোড়া গুলিতে এক ইএফআর জওয়ান এবং ঝাড়গ্রাম থানার এক সাব ইন্সপেক্টর নিহত হন। জখম হন কয়েকজন। ২০১০ সালের ২০ মার্চ লালগড়ের ধরমপুরে সিআরপিএফ এবং পুলিশকে সরকারি কাজে সশস্ত্রভাবে বাধাদানের একটি মামলাতেও তারা অভিযুক্ত। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় এ দিন তারার জামিন মঞ্জুর করে আদালত। শিলদা ও ঝাড়গ্রামের মামলা দু’টিতে জামিনের আবেদন খারিজ করে তারাকে ১৪ দিন জেল হাজতের নির্দেশ দেন বিচারক। তারার আইনজীবী কৌশিক সিংহ বলেন, “তারা ওরফে ঠাকুরমণি তৎকালীন পরিস্থিতির শিকার হয়ে আজ বহু মামলায় অভিযুক্ত।”
বিনপুরের রঘুনাথপুর গ্রামের বাড়িতে বসে গালুবাবু বলেন, “মেয়ে-জামাই স্যারেন্ডার করলে ভাল হত। ওরা ধরা পড়েছে, ফলে এখন বিচারে কী যে হবে!” পাশ থেকে সুর করে ঝাঁঝিয়ে পূর্ণিমাদেবী জবাব দেন, “মাওবাদীর কর্মফলে ভাগ্যে জেল থাকলে, সুখভোগ ফেল।” ছবি: দেবরাজ ঘোষ।